ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সহযোগিতা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি

 এলসি জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে চিনি আমদানি

​​​​​​​এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২২:১৯, ১৭ মার্চ ২০২৩

 এলসি জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে চিনি আমদানি

.

সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের পরও শুধু এলসি জটিলতার কারণে চিনি আমদানি হতে পারছে না। কারণে আমদানি বাড়ানো এবং রমজানে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে চিনি আমদানিতে দ্রুত এলসি খোলার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে আমদানিকারকরা চিনি আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না। ফলে দ্রুত চিনির মজুত ফুরিয়ে আসছে, ফের বাড়তে শুরু করেছে দাম। রমজানের সময় ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। তখন চিনির সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতিকেজি খোলা প্যাকেটজাত চিনিতে ১২-২০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিয়ে ১১৫-১২৫ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। অবস্থায় চিনি আমদানিকারকদের এলসি খোলায় অগ্রাধিকার প্রদানে সহযোগিতা চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় চিনির আমদানি বাড়াতে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে সহযোগিতা চেয়ে অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, চিনি আমদানিকারকদের এলসি খোলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের সহযোগিতা প্রয়োজন। চিঠিতে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২, এই তিনমাসের তুলনায় ডিসেম্বর ২০২২-ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে চিনি আমদানি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বাজারে চিনির সরবরাহ বৃদ্ধির অবকাশ রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

উল্লেখ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে জারিকৃত এসআরও এর মাধ্যমে পরিশোধিত অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে আরোপিত কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে হ্রাস করে ২৫ ভাগ করা হয়েছে।

ফলশ্রুতিতে তুলনামূলক কমমূল্যে চিনি আমদানি করা সম্ভব হবে এবং অপরিশোধিত চিনির সুরক্ষা মাত্রা হ্রাস পাওয়ায় পরিশোধিত চিনি আমদানি উৎসাহিত হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে। বাস্তবতায় দ্রুত পরিশোধিত চিনি আমদানির মাধ্যমে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী চিনির সরবরাহ নিশ্চিত করে মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে চিনির চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে চিনি আমদানিকারকদের এলসি খোলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের সহযোগিতা প্রয়োজন। অবস্থায় বাজারে চিনির মূল্য সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে চিনি আমদানিকারকদের এলসি খোলায় অগ্রাধিকার প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।

ইতোমধ্যে চিঠির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সচিব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বরাবর পাঠানো হয়েছে। রমজান সামনে রেখে দ্রুত চিনি আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, রমজানে চিনির বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে, আর কারণেই সব ধরনের কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহার করে চিনি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডলার সংকটসহ নানা কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের এলসি নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। বিষয়টি সরকারের নজরে আসায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে এলসি খোলা সহজ হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি হবে।

তিনি জানান, এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনি আমদানিতে ডিউটি প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছিল। এনবিআর সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমদানি শুল্ক কমিয়েছে।

এদিকে চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, দেশবন্ধু সুগার মিলসহ সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় চিনি আমদানিতে জোর দিয়েছে। কিন্তু এলসি জটিলতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ছাড়া দ্রুত পরিশোধিত চিনি আমদানিতে ঢাকার মৌলভী বাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু তারাও (পাইকারি ব্যবসায়ী) এলসি জটিলতার কথা বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌলভীবাজারের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী জনকণ্ঠকে বলেন, এবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় পরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি বড় সুযোগ। কিন্তু এলসি জটিলতার কারণে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পরিশোধিত  চিনি আনা যাচ্ছে না। দ্রুত এলসি খোলার বিষয়টি সহজ করা হলে আমদানি বাড়বে এবং ভোক্তারা কমদামে চিনি কিনতে পারবেন। 

জানা গেছে, রমজান মাস সামনে রেখে দাম কমাতে সব ধরনের চিনিতে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। চিনির বাজারে স্বস্তি দিতে আগামী ৩০ মে পর্যন্ত অর্থাৎ তিনমাসের জন্য শুল্ক সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা। শুল্ক সুবিধা কার্যকর হলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিকেজি চিনিতে দাম কমবে সাড়ে থেকে সাড়ে টাকা পর্যন্ত। যদিও চিনির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা কার্যকরের বিষয়টি নির্ভর করছে মিল মালিকদের ওপর। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার নিয়ন্ত্রক শুল্ক কমানোর পর অপরিশোধিত পরিশোধিত চিনির সামগ্রিক আমদানি খরচ টনপ্রতি যথাক্রমে সাড়ে হাজার টাকা হাজার টাকা পর্যন্ত কমবে। বর্তমানে দেশে প্রতিকেজি খোলা চিনির সরকার নির্ধারিত দাম ১০৭ টাকা এবং প্রতিকেজি প্যাকেটজাত চিনি কিনতে খরচ হওয়ার কথা ১১২ টাকা। কিন্তু বাজারে এই দামে চিনি মিলছে না। ভোক্তাদের প্রতিকেজি খোলা চিনি ১২৫ এবং প্যাকেট চিনি ১২৫-১৪০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। এর আগেও কয়েকদফা দাম বাড়িয়ে সেই দামের তুলনায় আরও বেশি দামে চিনি বিক্রি করেছে মিল মালিকরা।

কারণে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত কোথাও সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর হচ্ছে না। রমজান মাস সামনে রেখে আরেকদফা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তবে আমদানি শুল্ক কমানোর এই সুবিধা কার্যকর হলে বাজারে চিনির দাম কমাতে হবে। প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, পরিশোধিত চিনির শুল্ক কমানোর ফলে অনেকেই এবার চিনি আমদানিতে উৎসাহিত হবেন। তবে দেশে চিনির দাম কমাতে হলে মিলগুলো থেকেই কমাতে হবে। তিনি জানান, উৎপাদনকারী মিল মালিকরা শুল্ক কমানোর সুবিধা পাবেন। তিনমাসে বিপুল পরিমাণ চিনি আসবে দেশে। কারণে ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমাতে সরকারি নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। এখন এলসি খোলার বিষয়টি জরুরি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অনীহা দেখা যাচ্ছে। চিনিসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে প্রমাণিত হয়েছে। প্রসঙ্গে সংস্থার মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে চিনির সংকট এবং দাম বৃদ্ধির পেছনে ইতোমধ্যে ৭টি কারণ চিহ্নিত করেছে অধিদপ্তর। এসব কারণের মধ্যে আছে গ্যাস সংকট, চিনি বেচা-কেনায় মুদ্রিত ভাউচার না দিয়ে কারসাজি এবং ব্যাংকে এলসি খোলার জটিলতা অন্যতম।

×