ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

নড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ২০০ বছরের সন্দেশ

বিপ্লব হাসান হৃদয়, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শরীয়তপুর

প্রকাশিত: ১৪:০২, ১১ জুন ২০২৫

নড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ২০০ বছরের সন্দেশ

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং একটি বিশেষ মিষ্টির জন্যও সুপরিচিত — সেটি হলো ‘নড়িয়া সন্দেশ’। প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বাদ ও ঘ্রাণে মানুষের মন জয় করে চলেছে এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বহু আগেই।

সুস্বাদের জন্মকথা
জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রায় দুই শতক আগে নড়িয়ায় সন্দেশ তৈরির শুরু। মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা এলাকার নামের সঙ্গে মিলিয়ে মিষ্টির নাম রাখেন ‘নড়িয়া সন্দেশ’। তাঁদের দাবি, এই অঞ্চলের মতো এমন সুস্বাদু সন্দেশ আর কোথাও তৈরি হয় না। টাটকা গরুর দুধ থেকে তৈরি ছানা আর খাঁটি চিনি দিয়ে বানানো হয় এই মিষ্টি। কোনো রকম কৃত্রিম রং, ফ্লেভার বা প্রিজারভেটিভ ছাড়াই তৈরি হয় বলেই নড়িয়া সন্দেশের স্বাদ ও সুবাস একেবারে আলাদা।

নদী আর সন্দেশের যুগলবন্দি
নড়িয়া বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তিনাশা নদী শুধু এ এলাকার ভূগোলেই নয়, ঐতিহ্যেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ব্রিটিশ আমলে কীর্তিনাশা ছিল এক ব্যস্ত নৌপথ। দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ও ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বড় বড় স্টিমারে চড়ে কীর্তিনাশা পাড়ি দিতেন। যাত্রাবিরতির সময় নড়িয়াঘাটে নেমে সন্দেশ খেতেন ও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ধীরে ধীরে নড়িয়া সন্দেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে কলকাতাসহ নানা স্থানে।

হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় স্বাদ
নড়িয়া ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পরিচালক বিমল ঘোষ জানান সন্দেশ তৈরির বিশেষ পদ্ধতির কথা। সাধারণত ছয়-সাত কেজি দুধ থেকে পাওয়া যায় এক কেজি ছানা। সেই ছানায় এক কেজি চিনি মিশিয়ে অল্প আঁচে ২০-৩০ মিনিট জ্বাল দিতে হয়। এরপর পাঁচ মিনিট হালকা আঁচে রাখলে তৈরি হয় সন্দেশের মিশ্রণ। পরে সেটিকে গোল করে হাতে চেপে আকার দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের সংরক্ষক বা বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা হয় না।

ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার লড়াই
একসময় নড়িয়ায় অর্ধশতাধিক দোকানে সন্দেশ তৈরি হতো। কিন্তু এখন মাত্র ছয়-সাতজন কারিগর এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাঁদের একজন বিমল ঘোষ বলেন, “দুধ, চিনি আর শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। লাভ কমে গেলেও মানের সঙ্গে আপস করছি না। আমার দাদা, বাবা এই ব্যবসা করেছেন, আমিও করছি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক — এটাই চাওয়া।”

স্বাদে বিশ্বজয়
নড়িয়া সন্দেশের খ্যাতি এখন কেবল স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। শরীয়তপুরের অনেক প্রবাসীও বিদেশে এই সন্দেশ নিয়ে যান। সন্দেশপ্রেমী রুবেল খান জানান, “শৈশব থেকেই নড়িয়া সন্দেশের সুনাম শুনে আসছি। এখনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়ার সময় সন্দেশ নিয়েই যাই। বিদেশের মানুষরাও খেয়ে মুগ্ধ হন।”

শরীয়তপুরের প্রবীণ সাহিত্যিক শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, “নড়িয়া শহরের কোনো লোক কোথাও বেড়াতে গেলে হাতে সন্দেশের প্যাকেট থাকবেই। এই সন্দেশ যেন তাদের গর্বের প্রতীক।”

পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন
যুগের পর যুগ ধরে নড়িয়া সন্দেশ তার গুণে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। কিন্তু কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, আধুনিক বাজার ব্যবস্থার অভাব ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ এটি সংকটে পড়েছে। সঠিক সহযোগিতা পেলে নড়িয়া সন্দেশ আরও অনেক দূর যেতে পারত। এই ঐতিহ্য শুধু নড়িয়ার নয়, পুরো দেশেরই এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক সম্পদ।

মুমু ২

×