ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

চাই অনেক বৃক্ষসখা

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ১৫ জুন ২০২৫

চাই অনেক বৃক্ষসখা

গাছ কেনা ভালোবাসে। কিন্তু গাছের প্রতি তার ভালোবাসাটা একটু অন্যরকম। সবার চাইতে আলাদা। তিনি শুধু গাছ লাগানই না। গাছের পরিচর্যা করেন। নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন তিনি এক সবুজের অপূর্ব সমারোহ। গাছপ্রাণ এই মানুষটির নাম আরিফুর রহমান। নওগাঁর মহাদেবপুরে রাইগাঁ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এবং রাইগাঁ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এ পর্যন্ত তিনি এক হাজার তালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির সব মিলিয়ে ৫০ হাজারেরও বেশি গাছ রোপণ করেছেন। গাছগুলো ফল, ফুল দিচ্ছে। তালগাছগুলো বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমাচ্ছে। গাছের ছায়া পথিকের বিশ্রামের জায়গায় পরিণত হয়েছে। এসব কিছুতেই আরিফুরের পরম সুখ। আরিফুরের গাছ রোপণের শুরুটা সেই ছাত্রজীবন থেকেই। প্রায় ৪০ বছর আগে ছাত্রজীবনে নিজ গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে ইউনিয়নের বহুতি গ্রাম থেকে নিজ গ্রাম শহরাই হয়ে ডাবরকুড়ি পর্যন্ত- প্রায় ১ হাজার তাল গাছ রোপণ করেছিলেন, যা বর্তমানে তাল পার্ক নামে পরিচিত। শুরুতে মানুষজন নানা কথা বলত। উপহাস করত। কিন্তু আরিফুর একদমই এসব পাত্তা দেননি। তিনি নিজ খরচে বিভিন্ন রাস্তা ও প্রতিষ্ঠানে ফুল, ফল, বনজ, ঔষধিসহ নানা প্রজাতির গাছ রোপণ অব্যাহত রেখেছেন। যে কারণে বৃক্ষপ্রেমিক মানুষটি নিজ এলাকায় সবুজের ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত। 
বদলগাছীর শেষ প্রান্ত থেকে মাতাজী হয়ে নজিপুরের শুরু পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তায় প্রায় ৩ হাজার রঙিন ফুলের বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছেন। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালু, জাকারান্ডা, পলাশ, কদম, টগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, যা বর্তমানে শোভাবর্ধন করছে। এছাড়া রাইগাঁ ইউনিয়নের প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, খাস জায়গা, কাঁচা-পাকা রাস্তার দুই পাশসহ মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, স্কুল, কলেজ এবং মহাদেবপুর-বদলগাছী দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার বৃক্ষরোপণ করেছেন, যা এখনো চলমান রয়েছে। আরিফুর বলেন আমি চেয়েছি সব প্রতিষ্ঠান সেটা শিক্ষা, ধর্মীয় যাই হোক। সব জায়গায় একটি হলেও যেন আমার লাগানো গাছ থাকে। 
গাছ পরিবেশ বাঁচায়। মানুষের উপকারী বন্ধু। তাই গাছ লাগানোর বিকল্প কিছু নেই। এই ভাবনা তাকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছে সব সময়। নিজের পকেটের টাকা, সময় ব্যয় করে গাছের জন্য ছুটে গেছেন নানা জায়গায়। এ এক তার বিরামহীন চেস্টা। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধি। ছাত্র গড়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজও সামাল দেন দক্ষ হাতে। তবে এ সবকিছু ছাপিয়ে তার গাছপ্রেমী পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আরিফুরের এই গাছ লাগানোর উদ্যোগ সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে রাইগাঁ ইউনিয়ন এখন সবুজের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বজ্র্রপাতে প্রতি বছর বাংলাদেশে ৩০০ মানুষ মারা যায়। তালগাছ এই মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারে। তার লাগানো তালগাছ শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, বজ্রপাতের মতো শক্তিশালী দুর্ঘটনা থেকে রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কৃষকরা জানান, মাঠে কাজ করার সময় তারা তালগাছের নিচে বিশ্রাম নেন, দূরদূরান্ত থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা এসে ছবি, ভিডিও করে। অধ্যক্ষ আরিফ বলেন, ‘তালগাছ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে এজন্য ছাত্রজীবনে বন্ধুদের নিয়ে তালগাছগুলো রোপণ করেছিলাম। রাইগাঁ ইউনিয়নের সব রাস্তায় তালবীজ লাগিয়েছি’। 
আরিফুর তার এলাকার সবুজপ্রেমীদের প্রেরণা। তাকে অনুসরণ করছে অনেক তরুণ। তিনি কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানেও দু-চারটি গাছ লাগিয়ে আসেন। আরিফ বলেন, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। অনেক কিছুর বিনিময়ে এটি অর্জন করতে হয়। প্রবল আন্তরিকতা আর বুকের ভেতরের ভালোবাসার আকাশ ছাড়া এগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আরিফের গাছ লাগানো সম্পর্কে মাতাজিহাট বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি অধ্যক্ষ আরিফ একজন সমাজ দরদি মানুষ। মানুষের সেবা করা ও বিপদে সহায়তায় তিনি সব সময় আন্তরিক। এছাড়া বৃক্ষরোপণ তার নেশায় পরিণত হয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন গাছ লাগানো চলমান থাকবে। পাশাপাশি এলাকার সব প্রতিষ্ঠানে একটি হলে তার গাছ থাকবে।  এমনটাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তিনি একটি সবুজ ছায়া সুনিবিড় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন।

প্যানেল

×