
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আসীন ও বিশ্বের প্রবীণতম রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান। জীবদ্দোশায় রানীর ভারত ও বাংলাদেশ সফরের সময় রেলের যে বিশেষ কোচটিকে ভ্রমণ করেছিলেন তা এখন ইতিহাস। সেই স্মৃতি এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের দেশের উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। তবে কোচটি পরিদর্শনে উম্মুক্ত রাখা না হলেও কেউ চাইলেই অনুমতি সাপেক্ষে সৈয়দপুর এসে রেলকারখানার সংগ্রহশালাটি পরিদর্শন করে যেতে পারেন। ঈদের লম্বা ছুটির ঘোরাঘুরিতে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভ্রমনের সেই রেলকোচটির আরেকটি ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদ আপনারা দেখে যেতে পারেন।
দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ শুধু ভারত নয় ,১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সফরও করেছিলেন রানী। এর আগে তিনি ১৯৬১ সালে স্বাধীন বাংলার প্রথম ভারত সফর করেন। ওই সময ট্রেনে ভ্রমন করেছিলেন। ব্রিটেনের রানির প্রথম ওই সফর ছিল স্মৃতিবিজড়িত।ওই সময় রানীর ভ্রমনের জন্য বিশেষ ধরনের কাঠের তৈরী ট্রেনের দুইটি কোচ তৈরী করা হয়েছিল রাজপ্রাসাদের আঙ্গিকেই। যা ব্রিট্রেন থেকে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার মধ্যে সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায় রানি এলিজাবেথের ব্যবহার করা ছয় কামড়ার একটি সেলুন এখনও স্বযত্নে রাখা হয়েছে। ভেতরে আছে রাজকীয় শয়নক ও একটি কনফারেন্স রুম। কোচটির নৈপুন্যতা বলে দেয় এটি রানীর ট্রেন ভ্রমনের সময় ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদ ।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানায় গেলেই দেখা যাবে রানীর এই ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদ রেল কোচটি। কোচটির ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদ। প্রবেশদ্বারেই রয়েছে কোচটির ইতিহাস সংবলিত একটি ওয়ালবোর্ড। এক পা এগোতেই চোখে পড়বে নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা একটি কামরা। রয়েছে রানির সঙ্গে আসা পাইক-পেয়াদা ও তাঁর স্টাফদের জন্য থাকার আলাদা ক।এরপর দেখা যাবে একটি সভাকক্ষ। সেগুন কাঠের তৈরি বড় দুটি সোফা রাখা আছে সেখানে, সেই সোফার সামনে আছে ৮ থেকে ১০টি চেয়ার। নান্দনিক কারুকার্য দেয়ালজুড়ে।
লালগালিচা আর সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো পুরো সভাকক্ষ। সেখানে আলমারিতে আছে ড্রিংকস কেস ও ছাইদানি। রয়েছে এসি, নান্দনিক ডিজাইনের লাইটিং, ফ্যান, উন্নত কাঠের আসবাব আর দামি ঝাড়বাতি। এরপরেই আছে খাট, ফোল্ডিং বেসিনযুক্ত রানির জন্য বরাদ্দ করা দুই বিছানার একটি শয়নকক্ষ। দোতলা আলমারি, জিনিসপত্র রাখার জন্য তামার তৈরি ছোট দুটি পাত্র ও ঝাড়বাতি। এরপর এক কক্ষ জুড়ে বাথরুম। তার পুরো দেয়াল উন্নতমানের ছোট ছোট টাইলসে বাঁধানো। স্ক্রু দিয়ে আটকানো প্রতিটি টাইলস। সিলিংও সবুজাভ টাইলসে মোড়ানো। মেঝেতে কাঠের ওপর মোজাইক। সেখানকার ঝাড়বাতিগুলো নকশাদার ও রঙিন। দেয়ালজুড়ে তামা-পিতলের আলপনা। সাবান-শ্যামপু আর ব্রাশ রাখার জন্য আছে তামার তৈরি নান্দনিক ঝুড়ি। আছে বিশাল সবুজ মার্বেলের বাথটাব ও পিতলের ঝরনা।এরপরের কটি বাবুর্চিদের থাকার জন্য। তারপরের কক্ষটি রান্নাঘর। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এই কোচের ভেতরের রানীর জন্য ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদ তৈরী করা হয়েছিল। লাইটগুলো অচল হওয়ায় আলোর জন্য নতুন করে লাইট লাগানো হয়েছে।ছয় কামরা বিশিষ্ট এই পুরো কোচ লাল মখমলে কার্পেটিং করা। প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে একটি করে অ্যাটাচ বাথরুম ও বেলজিয়ামের উন্নত স্যানিটারি ফিটিংস। বোঝাই যায় না, এগুলো ৬৮ বছর আগের তৈরি। ট্রেনের সাধারণ কোচে ৮টি চাকা থাকলেও রানীর এই সেলুনটিতে রয়েছে ১২টি চাকা।
সৈয়দপুরে রেলকারখানার ক্যারেজ শপের ইনচার্জ মোমিনুল ইসলাম বলেন,রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আজ বেঁচে নেই। তার এই স্মৃতিটুকু আমরা বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষে কালে স্বাক্ষি হিসাবে রেখে দিয়েছি। কোচটির প্রতিটি অংশে ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এমন দুর্লভ নিদর্শন আমাদের ঐতিহ্যের গৌরব বহন করে চলেছে। যা নতুন প্রজন্মকে দেখার শেখার আলো ছড়াবে। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার প্রবেশ মুখে চোখে পড়ে নানা আকৃতির ও প্রকারের রেল ইঞ্জিন। কোনটি কয়লা চালিত স্টিম ইঞ্জিন, আবার কোনটি ডিজেল চালিত। সবকটিই যেন রেল প্রযুক্তির বিবর্তনের স্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, এই অঞ্চলটি রেলওয়ে যোগাযোগে কতটা সমৃদ্ধ ছিল তা নতুন প্রজন্ম সহজেই জানতে পারবে। এই জাদুঘর হবে তাদের ইতিহাস দেখার ও শেখার এক অপার সুযোগ ।তবে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি একটি কেপিআই এলাকা হওয়ায় অনুমতি ব্যতীত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এই সংগ্রহশালা এখনও উন্মুক্ত নয়।
কারখানার বিভাগীয় তত্ত¡াবধায়ক শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ বলেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই কোচে ভ্রমণ করেন। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে এটি মেরামতের জন্য আনা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। বর্তমানে ব্যবহার না হলেও, বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে স্বযত্নে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ব্রিটিশদের বানানো বিশেষায়িত এটি একটি কাঠের তৈরী রেলকোচ। রানী যখন ১৯৬১ সালে প্রথম ভারত সফর করেছিলেন তখন এই রেলকোচটিতে ভ্রমন করেছিলেন। তিনি ভারত সফর করে ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার এটি উপহার হিসাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েকে দিয়েছিলেন। তখন কোচটি প্রেসিডেন্ট সেলুন হিসাবে ব্যবহার হতো। ১৯৮৪ সালে কোচটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন থেকে এটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় সংরক্ষিত রয়েছে।
তিনি জানান, সৈয়দপুর রেলকারখানাটি কেপিআই এলাকা। তাই বাহিরের মানুষজনের প্রবেশে নিয়মকানুন রয়েছে। আমরা অচিরেই কেপিআই এলাকার বাইরে একটি উন্মুক্ত রেল জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। যেখানে স্থানীয় জনগণ থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও সহজেই ঘুরে দেখতে পারবেন দেশের রেল ইতিহাসের অমূল্য ভান্ডার। তবে অনুমতি সাপেক্ষে ঘুরতে আসা পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়।
Jahan