ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পাবনার ’তের জমিদার’ বাড়ি

হৃদয় হোসাইন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাবনা

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২০ মে ২০২৫

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পাবনার ’তের জমিদার’ বাড়ি

ছবি: জনকন্ঠ

পাবনা জেলার বেড়া উপজেলারতের জমিদার বাড়ি' রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বেড়া উপজেলার হাঁটুরিয়া গ্রামে একসময় তেরজন জমিদার বাস করতেন। কালের পরিক্রমায় তের জমিদার বাড়ি ভগ্নদশায় পড়েছে।

ভগ্নদশায় উপনীত হলেও হাঁটুরিয়া গ্রামের এই জমিদারির গল্প আজও লোকমুখে প্রচলিত। জমিদারদের পাইক-পেয়াদার কথা,গানের আসরের কথা,পাশেই যমুনা নদীতে রাজাদের ভাসমান প্রমোদতরীর কথা মানুষের মুখে কেবল গল্প হয়ে বেঁচে আছে। একসময় এই গ্রামে তেরজন জমিদার বাস করতেন। কারণে গ্রামটি তের জমিদারদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত পায়।

তের জমিদারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। এই ঐতিহ্যটি ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে শেষ চিহ্ন রয়েছে ভাঙাচোরা পলেস্তারা খসা বিশাল অট্টলিকা। শানবাঁধানো পুকুর। বাড়ির প্রবেশমুখে বাঘ-সিংহের পাথরের মূর্তি।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে জানা যায়,একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই হাঁটুরিয়া গ্রাম। বড় বড় বণিক বাস করতেন অঞ্চলে। পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র নাকালিয়া বাজারের সঙ্গে কলকাতার নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। প্রায় ১৯০০ শতকের শুরু থেকে গ্রামে দুই-একজন জমিদারের বাস ছিল। কথিত আছে পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালের পর থেকে জমিদারদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ তেরজন জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই তেরজন জমিদার হলেন প্রমথনাথ বাগচী,কাঞ্চীনাথ বাগচী, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ভবানীচরণ বাগচী, কালীসুন্দর রায়, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়, সুরেনচন্দ্র রায়, সুধাংশুমোহন রায়, শক্তিনাথ রায়, বঙ্কিম রায়,ক্ষুদিরাম পাল,যদুনাথ ভৌমিক যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক। এই জমিদারদের বসবাসের সময়কাল ছিল আনুমানিক বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি দেশভাগ পর্যন্ত।

জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা গ্রামেই জমিদারি করতেন। হাঁটুরিয়া গ্রামের জমিদারের কথা উঠলেই একজন পেয়াদার কথা বলতে হয়। তার নাম লোকমান পেয়াদা। সেই সময়ের জমিদারদের অনেক কথা তিনি জানতেন। তিনি বহুকাল ধরে ছিলেন কালের সাক্ষী। জমিদার প্রমথনাথ বাগচীর পেয়াদা ছিলেন তিনি। তার বাবা-দাদাও জমিদারের পেয়াদা ছিলেন। তার মুখ থেকে অনেকেই সেকালের কথা শুনেছেন। তারা আবার সেই কাহিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বলে গেছেন। তের জমিদারদের কথা তাই এই এলাকার অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের জানা আছে। লোকমান পেয়াদার কথিত ইতিহাস অনুসারে, তের জমিদারের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাবৎসল ছিলেন জমিদার প্রমথনাথ বাগচী। প্রজাপীড়ক ছিলেন যদুনাথ ভৌমিক।

এক গ্রামে এতজন জমিদার থাকলেও তাদের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো না। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে সবাই মিলেমিশে উৎসব পালন করতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশভাগের আগে-পরে তারা সবাই একে একে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যান। কখনো আর ফিরে আসেননি।জমিদারদের প্রত্যেকেই বাস করতেন প্রাচীরঘেরা অট্টালিকায়। অট্টালিকার পাশেই ছিল শানবাঁধানো ঘাট। সংরক্ষণ সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বেশির ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে সেসবের অবস্থাও করুণ। একই রকম অবস্থা বড় বড় অট্টালিকার। মালিকানা বদলের পর কিছু অট্টালিকা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিছু কিছু যত্নের অভাবে ভেঙে গেছে।

সাক্ষী হিসেবে গ্রামে এখনো দু-তিনটি অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ রয়ে গেছে। জরাজীর্ণ এসব অট্টালিকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েকটি পরিবার। এমনি একটি পরিবার হচ্ছে দ্বিতল অট্টালিকায় বসবাস করা দিলীপ গোস্বামীর পরিবার। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নিয়ে তারা বাস করছেন। দিলীপ গোস্বামীর ছেলে দীপক গোস্বামী জানান,অট্টালিকার এক স্থানে এর নির্মাণকাল ১৯১১ সাল এবং নির্মাতা হিসেবে জমিদার ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের বাবা উমেশচন্দ্র রায়ের নাম খোদাই করা ছিল। তিনি ছেলেবেলায় এখানে সুপরিসর জলসাঘরসহ অনেক কক্ষ দেখেছেন। হলরুমে ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষের ছবি ছিল। জলসাঘরসহ সব কক্ষই এখন জরাজীর্ণ। ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। ঝুকিপূর্ণ জেনেও তারা এখানে বসবাস করছেন।

দর্শনার্থীদের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলে, ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এই বাড়িটি সংস্থার করে টিকিয়ে রাখার দাবি অনেকের।

মুমু

×