ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিশুর নতুন বাংলাদেশ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৬:০৩, ২ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২২:৪৭, ২ জানুয়ারি ২০২৫

শিশুর নতুন বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত।

আজকের শিশু আগামীর বাংলাদেশের নতুন কারিগর। তাদের জীবন চলা, শিক্ষা কার্যক্রম, পারিবারিক আবহ এবং অভিভাবকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার সঙ্গে অনবচ্ছেদ সামাজিক সংস্কার, অপঘাত, মূল্যবোধ ছাড়াও নিত্য জীবনের আধুনিক গতিপ্রবাহ। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল যাত্রায় এগিয়ে চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ওপর নতুন সময়কে যুক্ত করতেও ক্রমাগত চেষ্টা করছে। আবার মান্ধাতা আমলের কত বিধি কাঠামোর অভ্যন্তরে জিইয়ে থাকে সেটাও ভিন্নমাত্রার দুর্ভোগ।

সময়ের নতুন আবহ আর পুরনো অপসংস্কার এক সঙ্গে চলাও বিপত্তির কোপানল। সমাজ পরিবর্তনশীল। কাল আর যুগের আবহে নব স্রোতের অনুগামী হওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর বিভেদ-বিপত্তি ছাড়াও নানামাত্রিক অসমতা উঠে আসছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। সেখানে শিশুর জীবন, এগিয়ে চলা এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ণয়ও বিশেষভাবে বিবেচিত হচ্ছে। গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে সিংহভাগ অভিভাবকই তার শিশু সন্তানের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে ততখানি সচেতন নন। আর প্রতিবন্ধী সন্তানের বেলায় তা আরও দুর্বিষহ ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে। বলা হচ্ছে ১২৪ জন শিশুর মধ্যে মোটে ৩৯ জন পারিবারিক আবহ এবং অভিভাবকের অনুকূল সহায়তা পেয়ে থাকে। বাকিরা বিপরীত প্রতিবেশে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ণয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শিশু সন্তানরা নিজেরাও তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্বাচনে পিছু হটে কিংবা যথার্থ পথ নির্ণয়ে হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় পতিত হয়। যা দেশের সার্বিক মাধ্যমে ইতিবাচক প্রবাহের বিপরীত পর্যায়। 
একজন অবোধ, অপরিণত শিশু যদি যথার্থ লক্ষ্য নির্ধারণে পারিবারিক সীমানায় বিঘ্নতার মুখোমুখি হয় তা হলে দেশের তৈরি হওয়ার যাত্রাপথও বিলম্বিত করার দুঃসময়। ছাত্র আন্দোলনের পরম নিষ্পত্তিতে যে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া সেটা আলোচনায় আসতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছে না। কারণ পুরনো সংস্কারে নতুন সংযোজন সময়ের কঠিন যাত্রাপথ। দীর্ঘদিনের সংস্কার আর পুরনো আমলের ব্যবস্থা বরাবরই নতুন যাত্রাপথকে ঠেকাতে বিভিন্নভাবে চলে আসা নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়াকেও চ্যালেঞ্জের আবর্তে ঠেলে দেয়। তবে নতুন সংস্কার কিংবা দিকনির্দেশনাও সময়ের আলোকে নির্ণীত হয়। সেখানেও ধৈর্য ধরে নতুন আবহ তৈরি করা বিচক্ষণতা এবং বিবেচ্য বিষয়। আমরা বর্তমানে তেমন অবস্থা অতিক্রম করছি। পরিবেশ-পরিস্থিতি শুধু নতুন সময়ের আলো নয় বরং আগত বছরের অপার সম্ভাবনার দিকনির্দেশকও বটে। 

আমরা দেশের মেধা আর মনন যোগ্যতায় উচ্চশিক্ষার পাদপীঠের শিক্ষার্থী আন্দোলনের পরম পরিণতিতে নবতর এক যাত্রাকে স্বাগত জানাচ্ছি। শিক্ষার্থী মানেই স্পর্শকাতর এক অনন্য সময়ের দোলাচলে আবিষ্টই শুধু নয়, নবতর আবাহনে সৃষ্টির অভাবনীয় উন্মাদনাও নিভৃতে কাজ করে যায়। মোহাচ্ছন্ন এমন স্পর্শকাতর নিবেদন সংশ্লিষ্টদের যে যাত্রায় জীবনকে নাড়িয়ে দেয় সেটাও পরিবেশের আর এক অনন্য সম্ভাবনার বীজ। আলোচনা করছিলাম  শিশুর আশৈশব জীবন গড়ার অনন্য চলার পথের। সব শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকে আগামীর পথ চলার নব নির্দেশনা। সঙ্গতভাবেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনই শুধু নয় বরং সমতাভিত্তিক নতুন অবয়ব তৈরি যেখানে বিভেদ-বিভাজনের কোনো জায়গা সঙ্কুলানই হবে না। আর তার জন্য শুরু করতে হবে শিশু সন্তানদের জীবন গড়ার প্রারম্ভিক আঙ্গিনা। 

সম্প্রতি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হচ্ছে শিশুদের লক্ষ্য নির্ধারণে অভিভাবকদের ভূমিকা নাকি নগণ্যই। সেই সব গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন পূরণে তাদের অধিকার লক্ষ্য এবং পারিবারিক সুষ্ঠু বলয় সংশ্লিষ্টদের জন্য আবশ্যিক এক সুস্থ এবং নিরাপদ বাতাবরণ, যা তাদের সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশে নিয়ামকের ভূমিকা রাখবে। শুধু অধিকার নয় সংশ্লিষ্ট গৃহকোণ শিক্ষাঙ্গন থেকে পুরো সামাজিক প্রতিবেশ যে কোনো উদীয়মান ছোট প্রজন্মকে তার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার তালিম দিতে নির্ণায়কের ভূমিকায় থাকবে। সবকিছু জানাই শুধু নয় জীবনে অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও চলার পথের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রায় অংশীদার করবে সময়ের আলোকে। অধিকার, পরামর্শ, আগ্রহ যতই জরুরি হোক না কেন সবার আগে বিবেচনায় আনা সঙ্গত নির্দিষ্ট শিশুটির সক্ষমতা, স্বপ্ন এবং এগিয়ে চলার দক্ষতা। কারণ সব শিশুই একই সক্ষমতা দিয়ে জন্মায় না। তার ওপর পারিবারিক আবহ, মর্যাদাও শিশুদের মধ্যে তারতম্য তৈরি করে। যা কচি-কাঁচাদের জন্য শোভন কিংবা মঙ্গলজনক হয় না। যদি অভিভাবকরা সচেতন দায়বদ্ধতায় সন্তানদের আশৈশব জীবন গড়ার অনুকূলে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পিছু হটেন তা হলে জাতির ভবিষ্যৎও বিভিন্নভাবে হোঁচট খাওয়ার দুরবস্থায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা। এখানে শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফও তাদের হরেক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যায় আরও দুঃসহ চিত্র। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুদের বেলায়। আমাদের দেশে নাকি ৬০ ভাগ শারীরিকভাবে অক্ষম শিশু বিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত যেতে পারে না। যা চিরায়ত অপসংস্কার, অবকাঠামোর দৌর্বল্য এবং পিতা-মাতার অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। তাই এমন বিশেষ শিশুরা আলাদা মাত্রায় স্বাস্থ্যসেবা, সযত্ন পরিচর্যা এবং পারিবারিক নির্মল প্রতিবেশে তৈরি হয়ে থাকে। যাপিত জীবন ও আগামীর পথচলাকে নিরন্তর স্বাভাবিক করতে সাবলীল আর অনন্য শক্তিময়তায় পেছন ফিরে তাকাতেই না হয়।

সবচেয়ে বেশি জরুরি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর শিশুর জীবনে তার ইতি বা নেতিবাচক প্রভাব পড়া, যা কোনো বিকাশমান শিশুকে এগিয়ে নতুবা পেছনের দিকে ঠেলে দেবে। তেমন এক প্রাকৃতিক দুর্বিপাক নিয়ে অগণিত শিশু-কিশোরের স্বাস্থ্যঝুঁকির আবর্তে পড়া পরিস্থিতির নির্মমতা। ১৭৬০ সালের শিল্পবিপ্লবের নবতর আবিষ্কার দুনিয়াজুড়ে চমক সৃষ্টি করা ছিল এক অবিস্মরণীয় উদ্ভাবন। ইস্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারে বিজ্ঞানী জেমস ওয়াট যে নতুন প্রযুক্তি উপহার দিলেন সেটা শেষ অবধি দূষণের প্রক্রিয়াকেও প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দিতে এক অবর্ণনীয় দুঃসহ আবেশকে যেন স্বাগত জানানোর অবস্থা, কারণ তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় ঊনবিংশ শতাব্দী ক্রান্তিলগ্ন থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জোরেশোরে আওয়াজ তুলতে থাকেন সবুজ নিসর্গ ক্রমশ সতেজ অবস্থা থেকে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় নিপতিত হচ্ছে। তারই জের ধরে দূষণ নামক আর এক বিধ্বংসী বাতাবরণ জগৎজুড়ে অগ্নিদাহ তৈরি করছে। যা ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যকেও নানামাত্রিকে বিপর্যয়ের মোকাবিলা করিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ুর এমন বিরূপ প্রতিবেশ নাকি সর্বাগ্রে কোমলমতি শিশুদের আক্রান্ত করার চরম অশনি সঙ্কেত। যা  বিশ্বব্যাপী তোলপাড় করার ভিন্নমাত্রার দুর্ভোগ। শিশুদের ওপর জলবায়ুর ঝুঁকি নাকি একেবারেই মায়ের জঠর থেকে। বোঝাই যাচ্ছে গর্ভবতী মা থাকেন আর এক দূষণ পরিবেশের বিপন্ন আবহে। আশঙ্কিতভাবে উচ্চারিত হচ্ছে দূষণকে গ্রহণ করেই মাতৃজঠরে শিশুর ভ্রণই শুধু নয় কলুষিত এক প্রতিবেশে জীবনও স্বাস্থ্য সংশয়ে বেড়ে ওঠা জাতির আগামীর ভবিষ্যতের নিতান্ত দুর্ভোগ। সেখানে আর এক মহাসংকট অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত কন্যা শিশুর বিয়ে। যাতে আমাদের মতো ক্ষুদ্র বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে, আর এক দুর্বিষহ বিপরীত প্রদাহ। এক কন্যাশিশু অপরিণত মাতৃত্বের শিকার হচ্ছে জলবায়ুর বিপরীত প্রদাহে। যে শিশুটি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখছে সেও আলিঙ্গন করছে, আর এক দুর্ভোগের বিরূপ আশঙ্কার বলয়কে। সত্যিই এক নেতিবাচক প্রদাহের জ্বলন্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আগামীর প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন পরিবেশবাদীদের চরম উৎকণ্ঠা। ছিন্নমূল, পথ শিশুরা তো যত্রতত্র চষে বেড়ানো এক অনির্ধারিত যাত্রার প্রতিকূল অবস্থাকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। শুধু কি শিশুর শরীরে দূষণের চরম আক্রমণ? সঙ্গে বিবেচনা রাখা সঙ্গত শিশু শ্রমের অন্য মাত্রার অসহনীয় করুণ অবস্থা। বই হাতে যাদের বিদ্যালয় গমনের সময় তারাই বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো কঠিন হাতুড়ি নিয়ে কোমল হাতে ইট ভাঙছে অথবা মাথায় বোঝা নিয়ে নিজের কর্মজীবনকে বয়ে বেড়াচ্ছে। যা দেশ ও জাতির জন্য চরম এক দুঃসহ বলয়। বিচিত্র জীবনের কাঠখড় পোড়াতে শিশুদের যে নৈমিত্তিক দুর্যোগ আর বিষণ্ন্ন প্রতিবেশ সেখানে শরীর-মনের স্বাভাবিকতা ও সুস্থতা কোথায় ঠেকবে তা ধারণার বাইরে। তার ওপর শারীকিভাবে দুর্বল হতেও সময় নেবে না। তাদের জন্য নাকি থাকে আলাদা বিদ্যালয়। দেশের অগণিত শিশু বিভিন্ন সময় ক্লান্তিকালীন পর্বকে উত্তীর্ণ করতেও হিমশিম খায়। পিছিয়ে পড়াই শুধু নয় সামাজিকভাবে অব্যবস্থাপনার শিকার অনেক পথ শিশুর স্বাভাবিক জীবন কখনো সেভাবে নির্বিঘ্ন, স্বস্তিদায়ক হয়-ই না। তেমন বিপরীত প্রবাহে নিজেদের গড়ে তুলতে কত যে দুর্গতির কোপানলে পড়তে হয় সেটা সংবাদমাধ্যমের খবর হতে খুব বেশি পেছনে না থাকাও দৃশ্যমানতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সাধারণ মানুষের এমন চিত্র দেখায় অভ্যস্ত হলেও মানতেও কষ্টকর হয়। রাস্তায় যখন কোনো অবোধ শিশুকে ইট মাথায় নেওয়া কিংবা ভাংতে দেখা যায় তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমবয়সী নিজ সন্তানের কথা। বিবেকবান মানুষের তাই হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং ন্যায্যতা।

প্রাকৃতিক দূষণ কি শুধুমাত্র জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব? আরও শোচনীয়ভাবে অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় এমন অনেক দুর্যোগ যখন মানুষকে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার করায় সেখানে মা, শিশু ও বয়স্কদের জীবন বিপন্ন হওয়া পরিবর্তিত প্রতিবেশের নির্মম পেষণ। তবে নৈসর্গ বিশারদরা বলছেন প্রকৃতিকে নয়-ছয় করার দামও গুণতে হচ্ছে তার কোলের সন্তানদের। পরিবেশ তার দুঃসহ যাত্রাপথকে সামলাতে গিয়ে নির্মম প্রতিশোধেও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। শীতের আমেজে ঠাণ্ডা অনুভূত না হওয়াও পরিস্থিতির উল্টো রথ। সেখানে রাস্তায় ঠিকানা তৈরি করা শিশুরা শুধু উদ্বাস্তুই নয় বরং দেশের আগামীর প্রজন্মও নির্মমতার শিকার হওয়া অদম্য এক পালাক্রম। তাই নিসর্গ বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই বলেছেন প্রতিক্রিয়া নয়Ñ বরং প্রকৃতি সহায়ক যন্ত্র যা কার্বন নিঃসরণকে থামাতে ভূমিকা রাখবে তেমন প্রযুক্তিই বর্তমান বিশ্বের জন্য অত্যাবশ্যক। শিশু শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়াই শুধু নয় বরং শিশু শ্রমকে নির্দ্বিধায় জীবনের সঙ্গে একীভূত করা তাও কোনোভাবেই আকাক্সিক্ষত হতে পারে না। শিশুদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে পিতা-মাতার জীবন-জীবিকা। সেখানে আরও দুঃসহ অবস্থা। বাস্তুভিটা হারানো থেকে কর্মহীন জীবনের ঘানি টানা সবই যেন নির্মম প্রতিবেশের নৃশংস বাতাবরণ।

রাসেল

×