ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

নওগাঁর প্রত্যন্ত আমের রাজ্যে

শোয়েব মাহমুদ

প্রকাশিত: ২০:২২, ১১ আগস্ট ২০২৪

নওগাঁর প্রত্যন্ত আমের রাজ্যে

.

নওগাঁর সাপাহারে যাচ্ছি শুনে অনেকের ভ্রু-কুঁচকে গেলকি আছে ওখানে? সাপাহারকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন আমের রাজধানীএখানকার বরেন্দ্র ভূমি আমের জন্য বিশেষভাবে উপযোগীআমের ভরা মৌসুমে এখানকার আমবাগানগুলো ঘুরে দেখা হবে দারুণ অভিজ্ঞতাদুই দিনের এই সাপাহার ট্রিপের প্রথমদিন আমরা থাকব একটা এনজিওর রেস্টহাউজেএই রেস্ট হাউজটার বিশেষত্ব হচ্ছে- এটা মাটির তৈরিপরেরদিন থাকব প্রত্যন্ত একটা গ্রামে, আরেকটা মাটির তৈরি মেহমানখানায়এছাড়া ঘুরে দেখব ঐতিহাসিক দিবর দীঘি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সারা ফেলে দেওয়া ঘুঘুডাঙা তালের সা¤্রাজ্য

শেষমেষ ৪ জন মিলে ঢাকা থেকে রাতের বাসে রওনা হয়ে পড়লামবাস যখন আমাদের সাপাহারে নামিয়ে দিল তখন সকাল ৭টাএরপর একটা ভ্যানে চেপে আমরা আমাদের বুকিং করা রেস্টহাউজে গেলামআলোহা সোশ্যাল সার্ভিসেস- নামক একটা এনজিও গড়ে তুলেছে নান্দনিক একটা রেস্টহাউজযার নাম- তিলোত্তমা রিসোর্টতাদের এই ক্যাম্পাসের চারপাশটা আম বাগানে ঘেরাআর তার মধ্যেখানে নিরিবিলি মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সুন্দর এই থাকার ব্যবস্থাএই রেস্ট হাউজটার মূল বিশেষত্ব হচ্ছে- এটা মাটির তৈরিগ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি মানুষের কাছে গরিবের এসি হিসেবে খ্যাতি রয়েছেসেই ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখেই মাটির এই রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছেসঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিকতাঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে তাই এটা রূপ নিয়েছে নান্দনিকতায়এ রকম প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে এমন একটা থাকার জায়গা আপনাকে নিশ্চিতভাবেই মুগ্ধ করবেআমরা ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে বের হলাম আম বাগান ঘুরতেআমার এক পরিচিত ছোট ভাই হৃদয় তার বেশ কয়েকটা আম বাগান ঘুরিয়ে দেখালোকত জাতের যে আম- আ¤্রপালি, ক্ষিরসাপাতি, ল্যাংড়া, সুরমা ফজলি, আশ্বিনা, গোপালভোগ- আরও অনেক নাম বলেছিল, ভুলে গেছিবাগানের গাছ থেকে পেড়ে পাকা আম খাওয়ালোআম গাছের ছায়ায় বসে অনেকক্ষণ গল্প-আড্ডা হলো

উত্তরবঙ্গের পুড়ে ছারখার হওয়া গরমের কথা শুনেছিএবার সাপাহারে এসে সেটা ভালোই টের পেয়েছিতবে গরম ছাপিয়ে এখানকার চারপাশের গ্রামীণ প্রকৃতি আর সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করছেদুপুরে খেয়ে-দেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলামরোদ পড়ে গেলে বিকেলে আমরা গেলাম দিবর দীঘিতেএই দীঘিটা যেমন সুন্দর, তেমনি এর আলাদা একটা ঐতিহাসিক মর্যাদাও আছেদীঘির মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিজয় স্তম্ভ, যেটা দীঘিটার শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেসন্ধ্যা নেমে এসেছেআকাশে উঠেছে ঝলমলে বিশাল এক পূর্ণিমার চাঁদসেই চাঁদের উথাল-পাথাল আলোয় বোটে করে আমরা দীঘিতে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালামদীঘিতে ঘুরতে ঘুরতেই হৃদয় আর তার বন্ধুরা মিলে হঠা প্ল্যান করে ফেললো- আজ রাতে পিকনিক হবেদীঘি থেকে এসে একটা দোকানে মালাই চা খাচ্ছি আর আড্ডা দিচ্ছিওদিকে পিকনিকের আয়োজন চলছে মহাসমারোহেরাত বারোটার দিকে রান্না-বান্না শেষ হলোআমরা সবাই লাইন ধরে আমের আড়তের খড়ের ওপর বসে দেশী ঝাল মুরগি কষা, ডিম ভুনা আর সাদা ভাত দিয়ে বনভোজন পর্ব সারলামওরা রাত ১টার দিকে বাইকে করে আমাদের রেস্টহাউজে নামিয়ে দিয়ে গেল

বেশ সকাল সকাল আমরা ঘুম থেকে উঠে পড়লামআগের দিনই একটা অটো ঠিক করে রেখেছিলামসবাই ফ্রেশ হয়ে তিলোত্তমা রিসোর্টকে বিদায় জানিয়ে অটোতে রওনা করলাম পোরশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম নোনাহারের পথেযাওয়ার পথে রাস্তার দুধারে কেবলই আমবাগানগাছে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে আমএখানকার মানুষের ঘরগুলো বেশিরভাগই মাটির তৈরিসবমিলিয়ে, সাত-সকালে দুপাশের গ্রামীণ প্রকৃতি আর আমবাগান দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে বেশ রিফ্রেশিং লাগছিলপ্রায় ঘণ্টাখানেকের অটো রাইড শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের আবাসস্থল- কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্টেবরেন্দ্রভূমির হলুদাভ মাটি দিয়ে তৈরি বলেই হয়তো এর সৌন্দর্য যেন বেড়েছে কয়েকগুণএর আগেও মাটির তৈরি রেস্টহাউজে ছিলামতবে সেখানে আধুনিকতার একটা মিশেল ছিলকুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট সেদিক থেকে ব্যতিক্রমএরা সচেতনভাবেই আধুনিকতা পরিহার করে গ্রাম্য একটা আবহ তৈরি করেছেমাটির তৈরি কটেজগুলোর ছাদটা ছন আর বাঁশ দিয়ে বানানোশহুরে দূষিত জীবনে চলতে চলতে মাঝে মধ্যে থামতে হয়সেই বিরতিতে কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে এমন কুঁড়েঘরে থাকা নিশ্চিতভাবেই একটা আদর্শ জায়গাএখানকার এরা একে রিসোর্ট নাম দিলেও ভালোবেসে তারা কুঁড়েঘরকে বলে মেহমানখানা

পাশেই রয়েছে তাদের বিশাল জায়গাজুড়ে এগ্রো প্রজেক্টখিচুড়ি, ডিম ভাজা, আলু ভর্তা আর ডাল ভর্তা দিয়ে আরেকদফা সকালের নাস্তা সেরে আমরা একটা ভ্যান নিয়ে পুরো প্রজেক্ট ঘুরে দেখলামএই প্রজেক্টের একটা সুন্দর নাম দিয়েছে তারা- প্রজেক্ট গ্রীনিফাইযেখানে আছে বেশ কয়েকটা আমবাগান, আখক্ষেত, ড্রাগন ফলের আবাদ, নানারকম সবজির চাষাবাদ, এমনকি কফি চাষও করা হচ্ছেএরপর গেলাম তাদের গরুর খামারে

পর্যাপ্ত আলো বাতাস আর মুক্ত পরিবেশে গরুগুলো লালন-পালন করা হচ্ছেখামারের প্রজেক্টটার নামটাও সুন্দর- প্রজেক্ট বর্গাআমরা প্রজেক্ট ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেলকটেজে ফিরে এসে আলুভর্তা, সবজি, দেশী মুরগি আর আম ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলামবিকেলে রোদ পড়ে গেলে আমরা কুঁড়েঘরকে বিদায় জানিয়ে অটোতে করে রওনা হলাম নিয়ামতপুরের ঘুঘুডাঙায় অবস্থিত তালের স¤্রাজ্যের উদ্দেশ্যে৪০ মিনিটের মতো সময় লাগলো পৌঁছাতেপ্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে দুপাশে সারি সারি তালগাছ, মাঝখানে পিচঢালা রাস্তা, আশপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত- সবমিলিয়ে পুরো জায়গাটা অসাধারণশ্যামল বাংলার যে রূপের কথা বইয়ে পড়েছি, সেটাই যেন এখানে চোখের সামনে ধরা দেয়পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোয় আরও বেশি সুন্দর লাগছিল চারপাশটাদুদিনের দারুণ ট্রিপটার যবনিকাটাও তাই চমকার হলোসব মিলিয়ে, কাগজে-কলমে যখন এই অফবিট ট্রিপটার প্ল্যান করেছিলাম, তখন যা ভেবেছিলাম, বাস্তবে তার চেয়েও সুন্দর ছিল ট্রিপটা

×