
.
- দাদু, বাবা জানালায় লাল-সবুজ পতাকা টানিয়েছে কেন?
- আজ মহান স্বাধীনতা দিবস তাই।
ছোট্ট অঙ্কুর স্কুলে ভর্তি হয়েছে সবেমাত্র। রোজকার চারপাশ ঘিরে তার কৌতূহলের অন্ত নেই। দাদা-দাদু তার গল্প করা আর খেলার সঙ্গী, কাছের মানুষ। সকালের সোনা ঝরা রোদে দাদু বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে আর অঙ্কুর শুনছে স্বাধীনতার গল্প।
- স্বাধীনতা কি দাদু? আর স্বাধীনতা দিবস...?
- স্বাধীনতা হলো তুমি ইচ্ছেমতো যা করতে পার তাই।
এই যেমন ছবি আঁকার খাতায় রং দিতে পার আবার মুছতে পার এমন।
-ওহ! আচ্ছা... তাহলে স্বাধীনতা দিবস কি?
- স্বাধীনতা দিবস হলো আমরা যেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীন হওয়ার যুদ্ধ শুরু করলাম সেটা। এটার একটা লম্বা গল্প আছে। শুনবে তুমি?
- বলো... বলো!!
- আমাদের এই দেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। আমাদের দেশে অনেক ধান হতো, পাট হতো, অনেক সম্পদও ছিল। কিন্তু কি হতো জান? ওই পশ্চিম পাকিস্তানের দুষ্ট রাজাটা আমাদের সব সম্পদ নিয়ে যেত, আমাদের ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল...
ছোট্ট অঙ্কুর বুঝে না দাদুর এমন কঠিন কঠিন কথা। সে ছুটে যায় দাদার কাছে। আমাকে স্বাধীনতার গল্প বলো দাদা ভাই...! দাদার চোখে তখন রণাঙ্গনের দিন আর মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প ভেসে উঠে। ফিরে যায় সেই ’৭১ এ
- আসো দাদা ভাই.. তোমাকে গল্প বলি। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা ভোট হলো। পশ্চিম পাকিস্তানের দুষ্ট রাজার নাম ইয়াহিয়া খান আর আমাদের রাজার নাম কি জান?
- বঙ্গবন্ধু?
- হ্যাঁ..বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের মুজিব ভাই। অনেক অনেক মানুষ মুজিব ভাইকে ভোট দিল কিন্তু ওই দুষ্ট রাজাটা তাকে মেনে নিল না।
- সেকি! তোমাদের না নিয়ম.. ভোটে যে জিতবে সে রাজা হবে?
- হ্যাঁ দাদা.. তারপর বঙ্গবন্ধু বলল তোমাদের একটা কথা বলব তোমরা একটা বড় মাঠে আসো। অনেক মানুষ বাসায় জায়গা হবে না তাই। ওই মাঠের নাম কি জান? রেসকোর্স ময়দান। এখন সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবেই জানে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব একদিন সেখানে।
অঙ্কুর মন দিয়ে শুনছে। চোখে মুখে রাজ্যের প্রশ্ন। দুষ্ট রাজাটা ভোট মেনে নিল না...!!
- সত্যি যাবে....! এখনি যাই চলো! এখনি...
- তুমি আগে গল্পটা শোন..তারপর যাব। এরপর কি হলো! সেদিন ছিল ৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু বলল দেখ আমি ওদের ৬টি শর্ত দিয়েছি ওরা তা মানেনি। তারপর ওদের নিয়মে আমি রাজা হলাম ওরা তাও মানল না। এ রকম যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। যার যা আছে তাই নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে।
- তারপর কি হলো?
- তারপর সবাই সংগ্রাম করল। ওদের বলল.. কেন তোমরা তোমাদের নিয়ম মানছো না? ওরা বলে- আচ্ছা! আমাদের একটু সময় দাও..ভেবে দেখি। কিন্তু ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে দুষ্ট সৈন্য নিয়ে আসছে...জান!!
অঙ্কুর মাথা নাড়ে। আনমনে তাকিয়ে আছে পতাকায়...
-তারপর ২৫ মার্চ আসলো। দিন শেষে রাত হলো। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। তখন ওই দুষ্ট রাজার সৈন্যরা সবার বাসায় ঢুকে ঢুকে মানুষ মেরে ফেলল। কেমন কথা বলো..!!
- মানুষ মেরে ফেলল!!! পচা.. পচা। অনেক পচা দুষ্ট রাজা।
- হ্যাঁ দাদা ভাই.. .. অনেক দুষ্ট সেই রাজা! তারপর ওই দুষ্ট রাজা বঙ্গবন্ধুকে বলে... দাঁড়াও! তুমি রাজা হবা? তোমাকে জেলে আটকে দেই। বঙ্গবন্ধু কি করল জান? জেলে যাওয়ার আগে এক বন্ধুকে চিঠি লিখে গেল। ওই বন্ধুটার নাম মেজর জিয়াউর রহমান। সে সবাইকে জানালো আমাদের বঙ্গবন্ধু বলেছে- আমাদের সবাইকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।
- বাংলাদেশ??
- হ্যাঁ দাদা....আমরা আর পূর্ব পাকিস্তান থাকব না। আমরা স্বাধীন হব। বাংলাদেশ হব। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো। সবাই বলল- তোমরা যুদ্ধ করছো কেন??
আরে! আমাদের দেশটা হচ্ছে একটা সুন্দর দেশ। একটা ফুল! সেই ফুলটাকে ওরা অত্যাচার করে করে নষ্ট করে ফেলছে। ফুলটা বাঁচাতে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। ফুলটা বাঁচানোর জন্যই আমরা যুদ্ধ করলাম।
- তারপর....??
-ওই যুদ্ধের নাম কি জান? মুক্তিযুদ্ধ। আমরা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছি।
- দাদা ভাই...তুমিও যুদ্ধে গিয়েছিলে??
- হ্যাঁ ভাই...গিয়েছিলাম। যুদ্ধটা ছিল একটা কষ্টের যুদ্ধ। অনেক মানুষ রক্ত দিয়েছিল।
রক্ত শুনে অঙ্কুর ভয় পায়। দুহাতে চোখ ঢেকে রাখে। দাদাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কয়েকদিন অল্প অল্প করে চায়ের কাপে, ড্রয়িংরুমে, বারান্দায়, পার্কে হেঁটে হেঁটে অঙ্কুর স্বাধীনতার গল্প শোনে।
- দাদা..তোমরা কিভাবে যুদ্ধ করেছো??
- আমরা তো শান্ত মানুষ। ভালো মানুষ। যুদ্ধ করতে জানি না। তো বঙ্গবন্ধুর এক বন্ধু ছিল নাম তার কর্নেল ওসমানী। সে বলল- আমি তো জানি কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়। আমি তোমাদের শেখাব। কিন্তু দুষ্ট রাজার সৈন্যরা অনেক শক্তিশালী। ওদের সঙ্গে পারা যায় না। তখন আমরা নতুন এক ধরনের যুদ্ধ শিখলাম- গেরিলা যুদ্ধ। লুকিয়ে লুকিয়ে আক্রমণ আর যুদ্ধ।
-ওহ....... আচ্ছা!
- পুরো নয় মাস ধরে যুদ্ধ। সে কি লড়াই...সংগ্রাম! তোমার আম্মুদের.. আপুদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মেরে ফেলছে। যুদ্ধ চলছে.....চলছে। কোনোভাবেই ওই দুষ্টদের সঙ্গে পারা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু তখনও জেলে। তাঁর আরও বন্ধু তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান। তখন তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত কে বলল- তোমরা আমাদের অসহায় মানুষগুলো কে একটু আশ্রয় দাও। আমাদের সাহায্য কর।
এভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল। কত মানুষ মারা গেল জান? ৩০ লাখ...
অঙ্কুর হাতের কড়ায় গুনতে থাকে...১,২,৩...। অবাক চাহনি! বিস্ময়ে বিহ্বল।
- ৩০ লাখ হতে হাতে কতবার গুনতে হয়। এত্তগুলা মানুষ........????
- তারপর ডিসেম্বর আসল। ওই দুষ্ট সৈন্যদের অবস্থা খারাপ। ওরা আমাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তখন দুষ্ট রাজা বলল- থাক! থাক! আমরা আর যুদ্ধ চাই না। তোমরা তোমাদের দেশ নিয়ে নাও।
আমরা বললাম- না! না!! এমনি বললে হবে না বাপু! লিখে দাও। ওরা লিখে দিল আমরা আর পূর্ব পাকিস্তান না আমরা এখন থেকে বাংলাদেশ। সে দিনটা কবে জান? ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমাদের জয় দিবস। বিজয় দিবস। ওই জায়গাটা কোথায় জান দাদা ভাই? সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
- ওহ! ৭ মার্চের ভাষণের জায়গাটা?? তুমি না বলেছো আমরা ওখানে যাব বেড়াতে। চলো... এখনি চলো!!
পরদিন অঙ্কুর আর দাদা ভাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেল। বিজয়ের মঞ্চে পৎপৎ উড়ছে জাতীয় পতাকা। দুজনের চোখই চকচক করছে। তবে দুজনের আবেগ আর স্বপ্ন দুরকম।
- বিজয় শেষে তোমরা কি করলে??
অঙ্কুরের প্রশ্নে দাদা সম্বিত ফিরে পেলেন।
- তারপর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেলেন। আর তার সব বন্ধুদের নিয়ে দেশটাকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেন।
.....................
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। এক সাগর রক্ত আর দুলাখ বীরাঙ্গনার আর্তনাদে জয় করা এ দেশটি পালন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সেই ছোট্ট অঙ্কুর এখন সোমত্ত তরুণ। দাদা-দাদু কেউ বেঁচে নেই। ছেলেবেলায় অন্তরে প্রোত্থিত বীজ অঙ্কুরকে ইতিহাস- ঐতিহ্য জানার অনুপ্রেরণা জোগায়। সে বুঝে তারুণ্য হতে পারে এদেশের বড় শক্তি। দায়িত্ব তাই তার মতো হাজার অঙ্কুরের কাঁধে। বাহান্ন তে চার কোটি, একাত্তরে সাত কোটি আর সুর্বণজয়ন্তী তে এসে আমরা প্রায় উনিশ কোটি। প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব টুকু সততার সঙ্গে পালন করলে এদেশ হতে পারে সোনার দেশ। এ মহান উৎসবে এই হোক প্রত্যয়।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার