
শীতের কুয়াশার মধ্যে জীবনের পথচলা
‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই শীতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাঙালির জীবনে প্রকৃতিতে শীত আসে সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ নিয়ে। কবি পার্সি বিসি (পিবি) শেলীর কবিতার একটি পঙক্তি ‘ইফ উইন্টার কাম্স ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড’ (শীত যদি এসেই যায় ফাল্গুন তো দূরে নেই)। এবারের শীতের আগমনী পৌষ জানান দিচ্ছে ফাগুনের আবহ তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। প্রবাদে মাঘের শীতে বাঘ পালায়। এবারের তীব্র শীত সেই আভাস দিয়েছে। আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, এবারের শীতের দৈর্ঘ্য বেড়ে এপ্রিল পর্যন্ত ঠেকতে পারে। এখনই শীতকাবু মানুষের কাহিল হয়ে জবুথবু অবস্থা। বিজ্ঞানীদের কথাগুলো ভীতিকর করে দিচ্ছে। শীতের প্রীতিকর দিক রয়েছে। যেমন শীতের পিঠাপুলি। খেজুর গুড়। পিকনিক। গরম কাপড়ে ফিটবাবু হয়ে থাকা। শহরে মেলার আয়োজন। এগুলোর পাশাপাশি গ্রামীণ জীবন ততটা প্রীতিকর নয়। তবে গ্রামগুলো উন্নত এবং মাঠ পর্যায়ের মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ায় গ্রামীণ জীবনে শহুরে জীবনের ছাপ পড়েছে।
ডিসেম্বরে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়ে তার রেশ কাটেনি। খ্রিস্টীয় নতুন বর্ষের শুরু থেকেই ঘন কুয়াশা ও ভারী শিশির ঝরার পালা সমানতালে চলছে। হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। ঘন কুয়াশার আস্তরণে দৃষ্টিসীমা এক ফুটেরও কম। বইছে কনকনে হিমেল হাওয়া। পৌষের মধ্যভাগেই সমুখপানের ফাগুনের ধূলিঝড় উড়ছে মৃদু লয়ে। যদিও আবহাওয়া বিভাগ বলছে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির শীতে কয়েক দফা শৈত্যপ্রবাহ বইবে। তারপর বসন্তের দিনগুলো এসে যাবে। এর আগে শীতের ঘন কুয়াশা ও শিশিরের মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার পথ চলার পালা চলতে থাকবে। গ্রামীণ জীবনে আঙিনায় চুলার ধারে বসে তাপ নেওয়া। সকালে সন্ধ্যায় খরকুটা জ¦ালিয়ে উষ্ণতা নেওয়া। শরীরে চাদর আবৃত করে মুখ ঢেকে পথ চলা। সন্ধ্যারাতেই ঘরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমানো। শীতের রাতে শহুরে জীবনেও লোকজন তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে।
শীতের সাক্ষী কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে ফের আত্মপ্রকাশ রোদ্দুরে। দেখে সাধ মেটে না। প্রকৃতির মিলনমেলা কত বিচিত্র। রোমান্টিকতার মধুময়তা। প্রকৃতির সঙ্গেই মানুষের বাস। শেলী লিখেছেন ‘সুইটেস্ট সংগস আর দোজ দ্যাট টেল অব এ স্যাডেস্ট থট’। পর মুহূর্তেই তিনি বসন্তকেই খুঁজে এনেছেন শীতের মধ্যেই। বাঙালির ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে প্রকৃতিতে খুঁজে পাওয়া যায় নিসর্গ। জ্যোৎস্না রাতে পূর্ণিমায় ভরা চাঁদের মায়া। শীতের কুয়াশা (যা নিচে নেমে আসা মেঘ) জানান দেয় সামনেই রোদেলা দিনের ছোঁয়া। প্রতিটি ঋতু মানবজীবনের চলার পথকে এগিয়ে দিতে নানা প্রতিকূলতা নিয়ে আসে। এই প্রতিকূলতা যারা উত্তীর্ণ হতে পারে তারাই পায় শান্তির পরশ। প্রকৃতি নিয়ে দেশে দেশে কত কবি কত লেখক সাহিত্যিক কত কিছুই না বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসে টেনে এনেছেন প্রকৃতি। বিশ্বের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলুলয়েডের ফিতায় বিভূতিভূষণকে বন্দি করেছেন। শীতের বর্ণনায় সেক্সপিয়র বলেছেন ‘হে শীতের বাতাস, তোমার কনকনে শীতের দংশন অত নিষ্ঠুর নয় যত নিষ্ঠুর মানুষের নির্মমতা ও অকৃতজ্ঞতা।’
বাঙালির শীতের সংস্কৃতিতে প্রথমেই আসে পিঠাপুলি। কত বাহারি পিঠাই না বানানো হয় বাঙালির ঘরে। পিঠার যে কত নাম। গ্রামীণ জীবনে খেজুর গাছের মাথায় ঝুলতে থাকে কলসি। রাতভর টুপটুপ করে রস গড়িয়ে কলস ভরে ওঠে। খেজুর গাছের সঙ্গে শীতের মমত্ব বেশি। অতীতে গ্রামীণ জীবনে পাথারের ভিতরে মাটির হাঁড়ি-পতিল নিয়ে গিয়ে রান্না করে খাওয়া হতো। এর নাম ছিল পুষ্ণা। কেউ বলত চড়ুইভাতি। কেউ বলত বনভোজন। ইংরেজি নাম পিকনিক। ইংরেজি নামই স্থিতি হয়েছে। শীত মৌসুমে শহরে আয়োজন হয় নানা ধরনের মেলা ও উৎসবের। পিঠা উৎসব নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। গ্রামে বসে জারি সারি পালা গানের আসর। শীতের সকালে ও সন্ধ্যায় গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির উঠানে খড়ে ও আবর্জনায় আগুন জ¦ালিয়ে শীত নিবারণে আগুন পোহানোর দৃশ্য আজো আছে। শীত মৌসুমেই গ্রামের পথে-প্রান্তরে নজর কেড়ে নেয় হলুদ বরণ ফুলের শর্ষে খেত। মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের পালা শুরু হয়। শর্ষেকে নিয়ে কতই কথা। শর্ষের মধ্যে ভূত কথাটি যে কে আবিষ্কার করেছে! শর্ষে একটি ক্ষুদ্র দানা। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে ভূতের কোনো অস্তিত্ব নেই। ব্রিটেন ও আমেরিকার কিছু মানুষ এখনো ভূতের ভয় করে।
একটা সময় হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীত এলেই মানুষের দুর্দশা ও জবুথবু হওয়ার নানা চিত্র তুলে ধরা হতো। আজ আর সেই অবস্থা নেই। গত কয়েক বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের পালায় গ্রামের মানুষের ঘরে লেপ কাঁথা কম্বল ও শীতের পোশাক আছে। জেলা শহর ও উপজেলা সদরের পথের ধারে এবং গ্রামের হাটবাজারে এখন সস্তায় শীতের পোশাক মেলে। যা গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। শীতকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেই চেষ্টা করে। শীতের আরেকটি দিক হলো সর্দিকশি জ¦রজারি লেগে থাকে। যা শীতের বিব্রতকর অবস্থা। এভাবে শীত ফাগুনের আবেশে কেটে যায় মৌসুম। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফেরে পড়েছে শীতকালও। তারপরও শীতের আমেজ বলে কথা।