
আজ ২১শে জুন, উত্তর গোলার্ধের মানুষের জন্য বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন, পাশাপাশি সবচেয়ে ছোট রাত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই দিনটিকে বলা হয় কর্কটসংক্রান্তি বা উত্তর অয়নান্ত বা Summer Solstice। এর মানে হলো, আজ দিনের আলো থাকবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এবং রাত হবে বছরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। প্রকৃতির এই মহাজাগতিক নিয়মকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে রয়েছে নানা কৌতূহল ও উদযাপন।
বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত হওয়ায় এ দেশেও আজ দিনে থাকবে আলোর রাজত্ব। রাজধানী ঢাকায় এই দীর্ঘতম দিনের সাক্ষী হতে সূর্য উঠেছে ভোর ৫টা ১২ মিনিটে, আর সূর্যাস্ত হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ মিনিটে। অর্থাৎ, আজ প্রায় ১৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট জুড়ে থাকবে দিনের আলো।
কেন এবং কীভাবে এই দীর্ঘতম দিন হয়?
এই ঘটনার পেছনের মূল কারণ হলো পৃথিবী তার নিজের অক্ষের উপর কিছুটা হেলে রয়েছে। বিষয়টি সহজভাবে বুঝতে গেলে কয়েকটি জিনিস জানতে হবে:
১. পৃথিবীর হেলে থাকা অক্ষ: পৃথিবী তার কক্ষপথের সাথে সরলভাবে বা ৯০ ডিগ্রি কোণে ঘোরে না। এটি নিজের অক্ষের উপর প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে।
২. সূর্যকে প্রদক্ষিণ: এই হেলে থাকা অবস্থাতেই পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এর ফলে, বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ সূর্যের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে।
৩. কর্কটসংক্রান্তির অবস্থান: ২১শে জুন তারিখে পৃথিবী তার কক্ষপথে এমন একটি অবস্থানে আসে, যখন উত্তর গোলার্ধ (Northern Hemisphere) সূর্যের দিকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে। এর ফলে, সূর্যরশ্মি সরাসরি কর্কটক্রান্তি রেখার (Tropic of Cancer) উপর লম্বভাবে পড়ে।
৪. দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি: সূর্য এদিন উত্তর গোলার্ধের আকাশে দীর্ঘতম পথ ভ্রমণ করে। সূর্যোদয় হয় খুব তাড়াতাড়ি এবং সূর্যাস্ত হয় অনেক দেরিতে। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে (স্থানভেদে সামান্য তারতম্য হয়)। ঠিক এর বিপরীত অবস্থা ঘটে দক্ষিণ গোলার্ধে। সেখানে আজ বছরের ক্ষুদ্রতম দিন এবং দীর্ঘতম রাত পালিত হচ্ছে, যা তাদের জন্য Winter Solstice।
বিশ্বজুড়ে এই দিনটি কেবল একটি ভৌগোলিক ঘটনাই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উদযাপন।
আন্তর্জাতিক যোগ দিবস: আধুনিক বিশ্বে এই দিনের সবচেয়ে বড় উদযাপন হলো 'আন্তর্জাতিক যোগ দিবস' (International Yoga Day)। ২০১৪ সালে জাতিসংঘ ২১শে জুন তারিখটিকে যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রস্তাবিত এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য যোগ ব্যায়ামের গুরুত্ব তুলে ধরা। বিশ্বের বহু শহরে আজ সকালেই উন্মুক্ত স্থানে হাজার হাজার মানুষ যোগাসনে অংশ নেন। বাংলাদেশেও বিভিন্ন শহরগুলোতে দিবসটি উপলক্ষে আয়োজন হয় বিশেষ যোগ কর্মসূচির।
স্টোনহেঞ্জের সূর্যোদয়: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক সৌধ স্টোনহেঞ্জে (Stonehenge) আজও সূর্যোদয় দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। মনে করা হয়, প্রাচীন ড্রুইড যাজকেরা এই দিনটি জ্যোতির্বিদ্যা ও ধর্মীয় কারণে বিশেষভাবে পালন করতেন। বছরের এই দিনে সূর্য যখন ঠিক নির্দিষ্ট ফাঁকা পাথরের মধ্য দিয়ে ওঠে, তখন সেটিকে ঘিরে এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। প্যাগান, ড্রুইড এবং নিউ এজ সম্প্রদায়ের অনুসারীরা এই সূর্যোদয়কে এক পবিত্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেন।
মিডসামার উৎসব: সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে এই সময় 'মিডসামার' (Midsummer) উৎসব অত্যন্ত ধুমধাম করে পালিত হয়। মানুষজন ফুল দিয়ে নিজেদের সাজায়, বনফায়ার (Bonfire) বা আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে নাচ-গান করে এবং প্রকৃতির এই রূপকে উদযাপন করে।
বিশ্ব সঙ্গীত দিবস: পৃথিবীতে শান্তি ও ইতিবাচক চিন্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২১ জুন উদ্যাপিত হয় দিবসটি। এই দিবসটির সঙ্গে ফ্রান্সের উৎসব ‘ফেট ডে লা মিউজক’ উৎসবের যোগসূত্র রয়েছে। গ্রীষ্মের সবচেয়ে দীর্ঘ দিনের (২১ জুন) সারাদিন ধরে প্রথমবারের মতো এই সংগীত উৎসব শুরু করেছিলেন তখনকার ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং। এই উৎসব প্রথমবার প্যারিসে ১৯৮২ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এই ‘সংগীত দিবস’ বিশ্বে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং এখন বিশ্বের ১২০টি দেশে উদযাপিত হয়। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম দিবসটি পালন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ শনিবার চট্টগ্রাম নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে বিকাল ৫টা থেকে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যা চিটাগং ১৯৮৬ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে।
এরপর কী হবে?
আজকের পর থেকে উত্তর গোলার্ধে দিন ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করবে এবং রাত বড় হবে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে ২৩শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যেদিন দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান হবে, যাকে বলা হয় জলবিষুব (Autumnal Equinox)। এরপর ২২শে ডিসেম্বর আসবে বছরের ক্ষুদ্রতম দিন বা মকরসংক্রান্তি (Winter Solstice), যখন উত্তর গোলার্ধে রাত সবচেয়ে বড় এবং দিন সবচেয়ে ছোট হবে।
সব মিলিয়ে, কর্কটসংক্রান্তি কেবল একটি ক্যালেন্ডারের দিন নয়, এটি পৃথিবী ও সূর্যের সম্পর্কের এক অপূর্ব নিদর্শন, যা আমাদের প্রকৃতির বিশালতা এবং তার শাশ্বত নিয়মকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
মুমু