ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

স্পেনে মুসলিম ঐতিহ্যের ছায়া, রাজপ্রাসাদ থেকে র‌্যাপ সংগীতে

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সাজেক, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ১৮:১১, ২১ জুন ২০২৫

স্পেনে মুসলিম ঐতিহ্যের ছায়া, রাজপ্রাসাদ থেকে র‌্যাপ সংগীতে

ছবি: জনকণ্ঠ

প্রাচীনকালে সভ্যতা, সৌন্দর্য ও শিক্ষার বিচিত্র লীলাভূমি ও কীর্তিমন্দির হিসেবে যেসব মহানগরী খ্যাতি লাভ করেছিল, তার মধ্যে স্পেনে প্রতিষ্ঠিত নগরীগুলো অন্যতম। ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত স্পেন স্তূপ পর্বত এবং সাগরের কারণে খানিকটা বিচ্ছিন্ন।

অনেকেই জানেন না, এ স্পেনেই রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্যের সোনালি অতীত। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনন্য অধ্যায় সেই স্পেন এখন শুধুই স্মৃতি। হারানো সেই মুসলিম স্পেনে মুসলিম শাসনের ব্যাপক স্মৃতি আছে। মুসলিম আমলের একটি নাম আল-লাকান্ত থেকে আলিকান্তের উদ্ভব হয়েছে। মুসলিম শাসনামলে স্পেনের বেশির ভাগ অঞ্চলের মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলত, যার প্রভাব এখনো মানুষের ভেতর আছে।

যেমন আলিকান্তে শহরের সাইনবোর্ডে স্প্যানিশ ও ইংরেজির পাশাপাশি আরবিতে লেখা আছে ‘ওয়াসতুল বালাদ’ (শহরের মধ্যভাগ)। এই সাইনবোর্ডের পেছনে দীর্ঘ ৮০০ (৭১১-১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ) বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। সে সময় আরবিই ছিল স্পেনের ধ্রুপদি ভাষা। মুসলিম আমলে আরবি সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের অভাবনীয় বিকাশ ও অগ্রগতি হয়।

স্পেনের বর্তমান কথ্য ভাষার ওপরও আরবির প্রভাব দেখা যায়। যেমন ইনশাআল্লাহ থেকে আসা ওজালা এবং ফুর্ন থেকে আসা ফোর্নের মতো শব্দগুলো এখনো স্থানীয় উপভাষায় বিদ্যমান। বর্তমানে আরবি শুধু বহু স্প্যানিশ শব্দের বুৎপত্তির স্থল নয়, বরং রাস্তার সাইনবোর্ড, স্কুলের পাঠক্রম ও স্থানীয় র‌্যাপ সংগীতেও তার পুনর্জাগরণ ঘটছে। মরক্কান বংশোদ্ভূত হুদা, যিনি মিস রাইসা নামেও পরিচিত, তিনি বার্সেলোনার একজন সুপরিচিত র‌্যাপসংগীত শিল্পী।

রাইসা স্প্যানিশ, কাতালান ও আরবি ভাষায় র‌্যাপ করেন। এর মাধ্যমে তিনি আধুনিক স্প্যানিশ সমাজের মিশ্র সংস্কৃতির শক্তিশালী দিকটি তুলে ধরতে চান। এ ছাড়া তিনি আরব, মুসলিম ও মুসলিম নারীদের প্রতি প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে চান।

স্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, স্পেনের দৈনন্দিন জীবনেও আরবির ব্যবহার বাড়ছে। তা ঘটছে প্রধানত মরক্কো, আলজেরিয়া ও অন্যান্য আরব দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের মাধ্যমে।

আরব-স্প্যানিশ কালচারাল ইনস্টিটিউট কাসা আরাবির মহাপরিচালক মিগুয়েল মোরো আগুইলার জানান, ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে স্পেনের ১০ লাখ এক হাজার ৭৯২ জন নাগরিকের প্রথম ভাষা আরবি, যা জনসংখ্যার ২.১৭ শতাংশ। এর বাইরে বহু মানুষের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষা আরবি। ফলে অনারবদের আরবি শেখানোর জন্য বহু প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে।

আরবি ভাষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও কবি ফার্নান্ডো অ্যান্ডু রেসানো বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অভিবাসন প্রবণতা, বিশেষত উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেনে অভিবাসন, সুনিশ্চিতভাবে মিশ্র সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করছে, যা অনমনীয় স্থানীয় পরিচয়কে বিনম্র করবে।’ মাদ্রিদ অ্যাসেম্বলিতে ম্যাস মাদ্রিদের প্রতিনিধি জেমিনা গঞ্জালেস দাবি করেন, আরবি স্পেনেরই একটি ভাষা। গত মাসে আরবি ভাষা ও মরক্কান সংস্কৃতি শেখানোর পরিকল্পনাকে সমর্থন করে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি ক্যাথলিক ইসাবেলাও তা (আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি) মুছে ফেলতে পারেননি।’

স্পেনে আরবি ভাষা ও মরক্কান সংস্কৃতির পাঠদান চলমান শিক্ষাকাঠামোরই অংশ। দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে মরক্কো এবং স্পেন তাতে সম্মতি জানিয়েছে। মরক্কোর বংশোদ্ভূত শিশুদের আরবি ভাষা ও মরক্কান সংস্কৃতি শেখাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আন্দালুসিয়া, কাতালোনিয়া, মাদ্রিদসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই কার্যক্রম চলমান।

স্পেনের ‘রিয়েল একাডেমিয়া এস্পানোলা’-এর ভাষাবিদরা স্বীকার করেছেন যে চার হাজারেরও বেশি স্প্যানিশ শব্দ আরবি ভাষা থেকে এসেছে, যা স্প্যানিশ শব্দভাণ্ডারের প্রায় ৮ শতাংশ। লাতিনকে স্প্যানিশ ভাষার ভিত্তিভূমি মনে করা হয়। তবে স্প্যানিশ ভাষার ওপর আরবির স্থায়ী ও স্বতন্ত্র প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে বিজ্ঞান, কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনের নানা অনুষঙ্গে মুসলিম আমলে সৃষ্টি পরিভাষাগুলো এখনো ব্যবহূত হয়। যেমন কৃষি খাতে জাইতুন (জলপাই) থেকে আসাইতুনা, জাফরান থেকে আজাফরান ইত্যাদি। গণিতে আলজেবরা ও সিফর (শূন্য) থেকে সিরো ইত্যাদি। স্থাপত্যে আল কাসার (প্রাসাদ), আলমিনার (মিনার) ইত্যাদি। দৈনন্দিন আসবের মধ্যে আল মোহাদা (বালিশ), সুক্কার (চিনি) থেকে আজুকার ইত্যাদি।

ইউনিভার্সিটি অব আলমেরিয়ার অ্যারাবিক অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক লুইসা আরভাইদ দাবি করেন, স্প্যানিশ ভাষার ওপর সমকালীন আরবির প্রভাব সামান্য। কারণ আরব অভিবাসীরা দারজা ও আমাজিগের মতো উপভাষা ব্যবহার করে। তাঁদের অনেকে ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ ভাষায়ও কথা বলে।

তবে এটাও সত্য যে আরব বংশোদ্ভূত শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের শিল্পকর্মে শিকড়ের সন্ধান করেন এবং তাঁরা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। তাঁরা আন্তরিকভাবে চান স্পেনে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটুক।

শহীদ

×