
ছবি: জনকণ্ঠ
"নিঃস্বার্থ সেবার বাঁধনে, মিলেছি মোরা হৃদয়ের তানে" এই স্লোগানকে সামনে রেখে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত হলো জেলার ইতিহাসে প্রথম ‘স্বেচ্ছাসেবী মিলনমেলা’। জেলার নয়টি উপজেলার অর্ধশতাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একত্রিত হয় এই আয়োজনে, যেখানে মিলেমিশে যায় সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন আর তারুণ্যের স্পন্দন।
শনিবার (২১ জুন) প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপে ঘেরা খাগড়াছড়ির পর্যটন স্পট আলুটিলার অ্যামফিথিয়েটার চত্বর জুড়ে জমে ওঠে দিনব্যাপী এই উৎসব। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি যেন প্রকৃতিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণদের এই মহামিলনে। আবহাওয়া বৈরী থাকলেও স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণ আর প্রাণশক্তিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। ব্যানার, রঙিন টি-শার্ট আর চোখেমুখে সমাজের জন্য কিছু করার প্রত্যয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো আয়োজন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলার স্বেচ্ছাসেবক ও সংগঠক হাছানুল করিম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ.বি.এম. ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনাদের কিছু দাবি-দাওয়ার কথা শুনেছি, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনা হবে।”
এ সময় তিনি আয়োজক কমিটির প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে নগদ ২৫,০০০ (পঁচিশ হাজার) টাকা প্রদান করেন, যা স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ফেরদৌসী বেগম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মারুফ, এনডিসি এ. জেড. এম. নাহিদ হোসেন এবং সহকারী কমিশনার নোমান ইবনে হাফিজ।
অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল মুক্ত আলোচনা পর্ব, যেখানে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা তুলে ধরেন। কেউ বলেন দুর্যোগে পাশে দাঁড়ানোর গল্প, কেউ নারীর নিরাপত্তায় কাজ করার অভিজ্ঞতা শোনান, আবার কেউ কিশোর-কিশোরীদের আত্মবিশ্বাস গড়ার প্রয়াসের কথা বলেন কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রক্তদানের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। উঠে আসে পরিবেশ-সচেতনতা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্কিং ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নানা দিক। আলোচনা হয় এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের বিষয়েও, যা জেলার সকল সংগঠনকে একত্রিত করে সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করবে।
মিলনমেলাটি ছিল শুধু আলোচনা বা দেখা-সাক্ষাতের জায়গা নয়, বরং এক উৎসবমুখর দিন। সকালে উদ্বোধনী বক্তব্যের পর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় আলুটিলায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়, যা আয়োজনের পরিবেশবান্ধব চিন্তার প্রতিফলন। এরপর মধ্যাহ্নভোজের সময় সবাই একসাথে খাওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বন্ধন, তৈরি হয় স্মৃতি। বিকেলে ছিল বাস্কেটবল নিক্ষেপ ও হাড়িভাঙা প্রতিযোগিতা, যেখানে হাসি, উচ্ছ্বাস আর মজার মুহূর্তে ভরে ওঠে আয়োজনের প্রাঙ্গণ। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় গান, নাচ ও আবৃত্তির মধ্য দিয়ে আয়োজনটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর।
এই আয়োজন তরুণদের হাতে তৈরি এক অনন্য উদাহরণ। এটি শুধু একটি মিলনমেলা নয়, বরং খাগড়াছড়ির স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন, যেখানে তারা নিজেদের পরিচিত করিয়ে দিল নতুনভাবে, দেখাল সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নকে নতুন আলোকে।
রাতের আকাশে পাহাড়ের ওপারে মিলিয়ে যাওয়া আলোর রেখার মতোই, দিনভর জমজমাট এই মিলনমেলা শেষ হয় এক উজ্জ্বল প্রত্যয়ের বার্তা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবার বন্ধন থেকে গড়ে উঠবে আগামী দিনের সমন্বিত ও কার্যকর সামাজিক শক্তি।
শহীদ