
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টা বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এর বিরুদ্ধে জবাব দেয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর নারকীয় হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। খুনীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুভ সূচনা হয়েছিল মুজিবনগরে পঞ্চাশ কিলোওয়াট তরঙ্গ শক্তিসম্পন্ন ২৫ মে , ১৯৭১। প্রথম থেকেই উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু হয়েছিল বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রপ্রচার। প্রতিদিন সকাল ৭টা ও সন্ধ্যা ৭টা এ দুই অধিবেশনে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। এরও আগের ইতিহাস হচ্ছে, চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিতকর্মীসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণের সহযোগিতায়। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের দশজন, যাদের নাম স্মরণ করতেই হবে এবং যারা সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ, সৈয়দ আবদুস শাকের, আবদুল্লাহ আল ফারুক, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান এবং কাজী হাবিবুদ্দিন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শামসুল হুদা চৌধুরীর গ্রন্থে এসবের উল্লেখ আছে।
১৭ এপ্রিল ’৭১ কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হয় আব্দুল মান্নানের (এম.এন.এ) ওপর। পরবর্তীতে কলকাতার ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ চলত ছোট্ট একটা দ্বিতল বাড়িতে। চরমপত্র (বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা), অগ্নিশিখা (মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান), জাগরণী (উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান) এবং ইংরেজী ও বাংলা খবর ইত্যাদি দিয়েই শুরু হয়েছিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। চরমপত্র লিখতেন এবং পড়তেন এম. আর. আখতার মুকুল। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল মান্নান (ভারপ্রাপ্ত এম.এন.এ)। অগ্নিশিখা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, প্রযোজনা এবং নামকরণ করেন টি. এইচ. শিকদার।
অনুষ্ঠানে বাণীবদ্ধ করার জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরও একটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে পেশাগত স্টুডিওর ন্যায় কোন শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী। তবে সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী কিছু গান যেমন- ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘নোঙ্গর তোল তোল’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ ইত্যাদি আরও অনেক গান। দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় ছিল আমাদের রান্না ঘর, ওখানেই আমরা খেতাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গানের রিহার্সেল এবং রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ করে ঐ বাড়ির দোতলায় স্টুডিওর পাশের রুমে খোলা মেঝেতেই চাদর পেতে শুয়ে পড়তাম আমরা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগাদান করার পর একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে সঙ্গীত পবিবেশনই ছিল আমার মূল কাজ। বহু সঙ্গীত পরিবেশন করেছি দীর্ঘ নয় মাসে। এর মধ্যে সমবেত এবং দ্বৈতভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রথম গাওয়া দ্বৈত সঙ্গীত- কথা : শহীদুল ইসলাম, সুর : হরলাল রায়, আমার সহশিল্পী ছিলেন তখনকার ইংরেজী সংবাদ পাঠক, প্রাক্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চেন্সেলর প্রফেসর ড. নাসরিন আহমেদ। গানের কথা: জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ, আমার দেশ আমার...। গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ২১ অক্টোবর ১৯৭১ দ্বিতীয় অধিবেশনে। গানটি শুরুর আগে ঘোষক ঘোষণা করেন- এবার শুনবেন একটি দেশাত্মবোধক গান, দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন- শিল্পী অরূপরতন চৌধুরী ও নাসরিন আহমেদ। গানটি প্রচারের দিন আমার নাম প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়। সেইদিন থেকেই বাংলাদেশে থাকা আমার মা, বাবা ও ভাই-বোন জানতে পারে যে, আমি বেঁচে আছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যুদ্ধ সংবাদ, সঙ্গীত ও কবিতা, নাটক কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সরব উপস্থিতি সেই সঙ্কটকালে সবার জন্য ছিল নব উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মনোবল না হারানোর অনুপ্রেরণা। মানুষের আগ্রহ আর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বেতার কেন্দ্র। সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুধু অনুপ্রাণিত আর উৎসাহিতই করেনি, সেই সঙ্গে যারা বাংলাদেশে ছিল তাদেরকেও উৎসাহিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জোগাতে। গানগুলো এখন নতুন প্রজন্মের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়, তাদেরকেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
একথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক সংগঠিত ও গতিশীল হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি দেশের মানুষের জন্য যেমন ছিল একটি আশা-ভরসার স্থান, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল ব্যপক উৎসাহ ও প্রেরণার উৎসস্থল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো এই বেতার কেন্দ্রটিও ছিল আর একটি সেক্টর, যেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবরই শুধু প্রচারিতই হতো না, অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকেও পরিচালিত করত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম, যার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটির সাফল্য ছিল একটি সুন্দর টিম ওয়ার্কের জন্য। অনেক কণ্ঠশিল্পী, নাট্যকর্মী, সংবাদ-পাঠক, কলাকৌশলী এবং সংগঠক তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে সচল রেখেছেন। যাদের অনেকেই আজ নেই, তাদের সকলের নাম আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আজ অসুস্থ। বিছানায় শয্যাশায়ী কেউবা নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন যাপন করছেন। আমাদের এখন প্রয়োজন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। তাদের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করা। জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকরা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালীর মনোবলকে অক্ষুণœ রাখার জন্য দিবারাত্র কাজ করেছেন। তাদের ক্ষুরধার প্রচার মুক্তিযুদ্ধের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে সর্বাত্মকভাবে। এই বেতার কেন্দ্রের এক একটি শব্দ ইথার ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে এক একটি বুলেট হয়ে।
কলকাতার ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজও বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভবনটি।’ বয়সের ভারে মলিন হয়েছে ভবনের রং, আশপাশে আরও বড় ভবনের পাশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মূল ভবনটিকে ছোট মনে হয়। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা অনন্য এই স্থাপনাটির অবস্থান আজীবন আকাশ সমান! তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে যেন সেই কথা, আমাদের সেই অনুভূতি যেন অব্যক্ত থেকে না যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই কেন্দ্রটির অসামান্য অবদান ইতিহাসের আড়ালে যেন চাপা না পড়ে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভবনটির যথাযথ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা প্রয়োজন। যাতে আগামী প্রজন্ম মহান মুক্তিযদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ভারতের সহায়তা ছিল অগ্রগণ্য।
তাই ভারত সরকারের কাছ থেকে ভবনটির স্বত্ব প্রয়োজনে কিনে নিয়ে হলেও ইতিহাসসমৃৃদ্ধ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ এবং একটি জাদুঘরে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা)