
‘এখন যৌবন যার’:
বড় উত্তাল সময়। অগ্নিগর্ভ দিন। গণআন্দোলনের জোয়ার। সালটা ১৯৬৯। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক যুবক একটি কবিতা লিখলেন। অগ্রজ সাহিত্যিক আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির যুবককে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার দফতরে। কবি আহসান হাবীবের কাছে। আহসান হাবীব এই পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর হাত দিয়ে কোনো তরুণের কবিতা প্রকাশিত হওয়া মানে সেই তরুণের ললাটে কবি স্বীকৃতি জুটে যাওয়া। যুবক কবিতাটি দিলেন আহসান হাবীবের কাছে। আহসান হাবীব পড়তে লাগলেন,
‘...
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।
...’
পুরো কবিতাটি পড়লেন। তারপর মিষ্টি করে হাসলেন। তিনজনকেই উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘শোনো তোমরা, এই কবিতাটি ছাপা যাবে না।’
অর্থাৎ অমনোনীত, তাইতো ভাবছেন? ভাবছেন, সম্পাদকের দপ্তরে যে বিস্তর বস্তাপচা কবিতা গিয়ে হাজির হয়, এই কবিতা তারই সহোদর? মনে মনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা স্মরণে এনে বলছেন, ট্রাস নয় তো কী? ভালো কবিতা কি এতই সস্তা, যে সম্পাদক পেয়েও ছাপাবেন না? না। আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আহসান হাবীবের পুরো কথা এখনো শেষ হয়নি। পুরো বক্তব্যটা আবার উদ্ধৃত করছি।
আহসান হাবীব বললেন, ‘শোনো তোমরা, এই কবিতাটি ছাপা যাবে না। ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। পত্রিকা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে একটা কথা বলি, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে। অমরত্ব ওর করায়ত্ত হয়ে গেছে।’
অগ্রজের এমন শংসাবাক্যে নিশ্চয়ই সেদিন বুক ভরে গিয়েছিল যুবকের। তবে আহসান হাবীব যে প্রকৃতই একজন গুণী সম্পাদক ছিলেন, কবিতা বিচারে তিনি যে একজন খাঁটি জহুরি ছিলেন, এই ভবিষ্যৎ বাণী তার আরেকটি উদাহরণ। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল তাঁর এই কথা। তিনি যে যুবক সম্পর্কে এই কথাটি বলেছিলেন, সেই যুবক হলো কবি হেলাল হাফিজ। আর যে কবিতাটি পড়ে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন, সেই কবিতার প্রথম দুই লাইন হলো,
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
[নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়]
বিশ^াবিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো ভরে উঠলো এই কবিতার পঙ্ক্তিতে। ছড়িয়ে পড়লো জনে জনে। এক পর্যায়ের কবিতার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কবির নাম। কবিকে চেনে না, নাম জানে না, অথচ এ কবিতা শুনেছে, এমন অনেক পাঠক এখনো পাওয়া যাবে।
তবে কবি শুধু ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা লিখেই থেমে যাননি। একের পর এক কবিতা লিখতে লাগলেন। দ্রোহের কবিতা, বিরহের কবিতা। প্রায় দেড় দশক ধরে লেখা কবিতা থেকে বাছাই করে ৫৬ টি কবিতা নিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘যে জলে আগুন জ¦লে’। পাঠকের বিপুল ভালোবাসায় সমাদৃত হলো বইটি। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হওয়া সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ¦লে’।
‘আমাকে পাবে না খুঁজে-কেঁদে কেটে মামুলী ফাল্গুনে’:
হেলাল হাফিজ এক সময় লিখেছিলেন,
‘আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে, Ñ ‘কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন বেঁধেছিলে উদ্বাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।’
[যুগল জীবনী]
কবিতার সঙ্গে যিনি যুগল জীবনযাপন করেছিলেন, কবিতাও যাকে এনে দিয়েছিলেন বিপুল খ্যাতি, সেই তিনি একদিন কবিতার কাছ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে গেলেন। পাঠক তাঁর নতুন কবিতার জন্য যখন উন্মুখ, তখন তিনি ‘ছিমছাম সন্ন্যাসী’ হয়ে যাপন করছেন অন্য জীবন।
এত পাওয়ার পরও তাঁর চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র সাফল্য, খ্যাতি আমার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছে যে, আমি এর পর লিখতে বসলে হাত কাঁপে, বইয়ের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমার দ্বিতীয় বই আমি এমনভাবে করতে চাই, যেন প্রথম বইকে অতিক্রম করতে না পারুক, এর কাছাকাছি তো যেতে হবে।’
আসলেই কি তাই? নাকি কোনো অভিমান, কোনো অতৃপ্তি তাকে নিয়ে গিয়েছিল বহুদূর। যা কবিতাতেই তিনি লিখেছেন,
‘কোনো প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়
কোনো প্রাপ্তিই দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি
সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে
গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা।’
[তৃষ্ণা]
১৯৮৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ‘যে জলে আগুন জ¦লে’র আলোয় পাঠক পেয়েছিল কবি হেলাল হাফিজকে। ২০১২ প্রথম বইয়ের ৫৬টি কবিতার সঙ্গে আরও পনেরোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত দ্বিভাষিক কবিতা-সংকলন ‘কবিতা একাত্তর’। ২০১৯ জুন মাসে পূর্বোক্ত কবিতার সঙ্গে আরও সতেরোটি কবিতা যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের কবিতাসমগ্র ‘এক জীবনের জন্মজখম’। এটিও কবির দ্বিভাষিক গ্রন্থ। ২০১৯ সালেই ৩৪টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় কবির দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
‘যাতায়াত’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।’
তবে আমরা মনে করি, পাঠকের ভালোবাসাই কবিকে ৩৪ বছর পর কবিতার কাছে আবার নিয়ে এসেছে।
‘স্বাধীনতা সব খেলো’:
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের যে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল, সেই স্বপ্নভঙ্গের ক্ষত রক্ত জবার মতো ফুটে আছে কবি হেলাল হাফিজের কবিতায়। ১৯৭১ সালে নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে এলো কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল শত বছর আগে। স্বাধীনতার আগমনে মানুষ ভেবেছিল, তাদের সব দুঃখ-দুর্দশা ঘুচে যাবে। পথের পাতা কুড়োয় যে মেয়ে, তারও কোনো কষ্ট থাকবে না। অভাব-অভিযোগ থাকবে না। হেলাল হাফিজ লিখেছেন,
‘কথা ছিলো একটি পাতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
[একটি পতাকা পেলে]
কিন্তু কথা রাখেনি স্বাধীনতা। মানুষ যে আশায় বুক বেঁধে ছিল, তা পূরণ হয়নি। পূরণ হয়নি তার স্বপ্ন। যে দুঃখহীন জীবনের ছবি দেখেছিল মানুষ, সেই অনুপম দিন কখনো ফিরে আসেনি সাধারণ মানুষের কাছে। তাই কবি ব্যথিত কণ্ঠে বলেছেন, ‘স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না।’
এজন্য কবি হতাশ, ক্ষুব্ধ। বাম রাজনীতিতে মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে পেতে চেয়েছেন। যারা মানুষের স্বপ্ন নিয়ে, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, কবি তাদের চেনেন। তাদের মুখোশ উন্মোচিত কবির কাছে। তাই কবি লিখেছেন,
‘ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতদিন ঠগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো অয় নাই হুঁশ।
গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।
[যার যেখানে জায়গা]
কবি এসব মানুষরূপী পিশাচদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন,
‘রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি
আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।
[ঐ]
মহাকালের কড়া নাড়ার জন্য একজন কবিকে হাজার হাজার পঙ্ক্তি রচনা করতে হয়। তাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না, তাঁর স্থান মহাকাল কোথায় লিখে রেখেছে? যাঁরা পারেন, তাঁরা ভাগ্যবান। আর কেউ কেউ আছে খুবই ভাগ্যবান, যাঁরা অল্প লিখে মহাকালের টিকিট পায়। তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। হেলাল হাফিজ সেই কমসংখ্যক মানুষদের দলভুক্ত।
‘মানব জন্মের নামে কলঙ্ক হবে’:
দেশের চলমান অস্থিরতা, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, সোচ্চার বাঙালির কণ্ঠে পুনরায় একটি কবিতা আবার উচ্চারিত হলো সম্প্রতি, ফেসবুকে ভাইরাল হলোÑ
‘মানব জন্মের নামে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।’
[দুঃসময়ে আমার যৌবন]
কবিতাটি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি। অথচ আজও কী প্রাসঙ্গিক! এই প্রাসঙ্গিকতা একজন কবিকে বাঁচিয়ে রাখে।
সমালোচক, শিল্পবোদ্ধাদের উন্নাসিকতাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে বলা যায়, দেশে যখনই কোনো আন্দলন, সংগ্রাম হবে, মানুষের অধিকারের কথা উঠবে, তখনই হেলাল হাফিজের কবিতা কণ্ঠে কণ্ঠে উঠে আসবে।
যখনই কোনো তরুণ কিংবা তরুণী হৃদয় ভাঙার নিষ্ঠুর খেলায় হেরে যাবে। হয়তো কোনো মন খারাপ করা বিষণœ সন্ধ্যায় আনমনে বলে উঠবে,
‘আমারে কান্দাইয়া তুমি
কতোখানি সুখী অইছো
একদিন আইয়া কইয়া যাইও।
[নীল খাম]
এজন্যই হয়তো হেলাল হাফিজ ‘আপনাকে, তোমাকে, তোকে’ উৎসর্গকৃত কবিতা তুলে দিয়ে যেতে চান ‘আগামী’র হাতে। ‘আগামী’কে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন,
‘আগামী, তোমার হাতে
আমার কবিতা যেন
থাকে দুধে-ভাতে’
[বাসনা]