প্রকৃতির অপূর্ব সমাহারে ভরপুর রূপসী কন্যা আমাদের জন্মভূমি। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে দুই মাস পর পরই ঋতু পরিবর্তন হয়। এই ঋতু পরিবর্তনে এখন বইছে শরৎকাল। আর প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় শরতের আগমনী বার্তা। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল- অর্থাৎ আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত। শরৎ ঋতুতে কাশফুল পুরো বাংলাদেশেই কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়। কাশফুল গুচ্ছমূল জাতের উদ্ভিদ ঘাস। এর মঞ্জুরি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পাতা কিছুটা রুক্ষতায় সরু সোজা রেখার মতো। উচ্চতা তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার পর্যন্ত হয়। কাশফুলের পাতাগুলো খসখসে, ধারালো হলেও কাশফুলগুলো খুবই নরম এবং কোমল। সাদা তুলার মতোই তুলতুলে এই ফুল। নদীর ধার, চরাঞ্চল, জলাভূমি, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হলো নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, নদীর ধারে কিংবা গ্রামের কোন প্রান্তে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা, গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোরধারায় শ্রাবণ ঢলের পর আসে শরতের রৌদ্রছায়ার খেলা-এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। আরও থাকে বিল ও ঝিলের পানিতে শাপলা শালুক ফুলের সুন্দর মায়াবী দৃশ্যের সমারোহ।
কাশফুল আবহমান বাংলার চিরচেনা শরতের সুন্দর স্নিগ্ধ ফুল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গ্রামবাংলার অপরূপ শোভা কাশবন ও কাশফুল ছিল যুগ যুগ ধরে চোখে পড়ার মতো চিরচেনা দৃশ্য। পথচারীদের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ও দৃষ্টি কেড়ে নেয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দাবিদার এবং প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাশবন ও ফুল এখন আগের মতো চোখে পড়ে না। ফলে অনেকে ভুলতে বসেছে দৃষ্টিনন্দন অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর কাশফুলকে। প্রকৃতির অপরূপ শোভাদানকারী ও সৌন্দর্যের প্রতীক কাশবন, ফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম কুশ। এরাও দেখতে প্রায় কাশফুলের মতোই আর ঋতুর রানী শরৎ মানেই কাশফুল, স্বচ্ছ শুভ্র নীল আকাশ আর দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ। শরতের ভোরের স্নিগ্ধতায় এ অপরূপ ঋতু শরৎকে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।’
শরৎ হলো প্রকৃতির ঋতু- তাই এই ঋতুতে প্রকৃতির শোভা বৃদ্ধি করতে ফুটে উঠে শিউলি, শাপলা, পদ্ম, টগর, কামিনী, মালতি, জবা, হাসনাহেনা এবং শুভ্র কাশফুল। কাশফুল শরতের আগমনের প্রতীক।
শরতকালেই সকাল বেলায় কুয়াশা পড়া শুরু হয়। শরতের সকাল বেলার কুয়াশা মাড়িয়ে খালি পায়ে হাঁটতে কার না মন চাই। সে এক আনন্দময় সুখকর স্মৃতি। সেই সঙ্গে কুয়াশার উপরে যখন সকালের সোনালী রবির আলো এসে পড়ে তখন শিশির বিন্দু মুক্তার দানার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সেই দৃশ্য আরও চমৎকার। দাখিনের সমীরণ খুলে শরতের নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো সবার কণ্ঠকেই সুরময় করে তুলে। এই তো সময় মন আমার হারিয়ে যাওয়ার। এছাড়াও মাঠে মাঠে বর্ষাও সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানির মুগ্ধতা। আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। শরতের শান্ত বিলের পানিতে যেন আকাশের মেঘ বালিকা নেমে এসেছে।
কাশ ঘাস শুকিয়ে গ্রাম অঞ্চলে মাদুর, ঘরের বেড়া ও ঘরের চালার ছাউনি, খড় ও ঝাটি পান-বরজের ছাউনি দেয়া হয়। এ ছাড়া পান-লতাকে উপরে উঠতে শলার (কঞ্চি) সঙ্গে বেঁধে রাখতে খুব দরকারি শুকনো কাশ খড়। শুকনা কাশ গ্রামের মানুষ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। বাণিজ্যিকভাবেও গ্রামীণ হাট-বাজারে বিক্রি হয় কাশফুলের পাতা। তা ছাড়া আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের মতে, কাশফুলের বেশকিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গাত্র দুর্গন্ধ দূর হয়। এ ছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হওয়াসহ এ উদ্ভিদটির আরও বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে। উদ্ভিদটির এতগুণ থাকার পরও তা সংরক্ষণ ও রক্ষায় কোন উদ্যোগ নেই। কাশফুল শোভন শুভ্র ফুল। প্রকৃতিতে কাশফুলের আনাগোনা দেখলেই প্রাণবন্ত ঋতু শরৎকালের রবি উদয় ঘটে প্রাণে। শরৎ ও কাশফুল যেন একই সুতার মালা। শরতের শ্রেত কাশফুলের সঙ্গে সাদা মেঘের মিতালি দেখা যায় শরৎকাল জুড়েই। বিস্তীর্ণ নীল আকাশে শ্রেত মেঘের ভেলা আর কাশফুলের সমারোহ শরৎ প্রকৃতির এক নান্দনিক রূপ। ধবল কাশফুল শোভন সুন্দর বলে সবুজ প্রাণ আর মেঘের আকাশ মিলে মূর্ত প্রকৃতি নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে।