ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অদম্য ইয়াসমিনের সফলতা

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ১৬:৪১, ১২ জুন ২০২৫

অদম্য ইয়াসমিনের সফলতা

ইয়াসমিন সুলতানা সচ্ছল পরিবারের সন্তান। স্বপ্ন ছিল বিচারক হয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু আকস্মিক বাবার প্রয়াণ এবং পরবর্তীতে দ্রুত বিয়ে তার সেই স্বপ্নকে আঁধারে ঢেকে দেয়। এর পরও ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স এবং ল’ পাস করে আইনজীবীর গাউন গায়ে তুলেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক ও সন্তানের কারণে সেখান থেকেও গুটিয়ে নিতে হয় নিজেকে। তবে তার পরও দমে যাননি ইয়াসমিন; নিজেকে গুটিয়ে নেননি নিজের জীবন থেকে। স্বামী-সন্তান সামলে উদ্যোক্তা পরিচয়ে সফলতার দ্বারে কড়া নাড়ছেন তিনি। হরেক রকম মসলা আর নান্দনিক খাদ্যপণ্যের ‘জননী’ তিনি। হোমমেড গুঁড়া মসলা ও বৈচিত্র্যময় খাদ্যপণ্যের কারবারে প্রতি মাসে তিনি উপার্জন করেন ২০-২৫ হাজার টাকা। 
ইয়াসমিনদের সংগ্রামের সারথী হয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। শুধু ইয়াসমিন নন; এমন অসংখ্য উদ্যোক্তাকে ‘অন দ্য জব’ প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণপরবর্তী সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। 
যশোর শহরের ধর্মতলা তিনখাম্বার মোড় এলাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ইয়াসমিনের স্বপ্ন ছিল ল’ পড়ে বিচারক হয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বাবা মারা যান। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের শেষে বিয়ে হয়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করতে করতে ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়েই মাস্টার্স, বিএড এবং এলএলবি কমপ্লিট করেন। এরপর শিক্ষানবিস আইনজীবী হিসেবে জজ কোর্টের ক্রিমিনাল সেকশনে সাড়ে তিন বছর প্র্যাকটিস করেন। এরই মধ্যে একটি সন্তান ‘মিসক্যারেজ’ হয়ে যায়। ২০১৯ সালে নতুন করে ‘কনসিভ’ করলে চিকিৎসকের পরামর্শে আইন পেশা ছেড়ে দেন। এরপরই উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা শুরু। সেই গল্প শোনালেন ইয়াসমিন। বললেন, ‘চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের জন্য সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারিনি। আইন পেশাও ছেড়ে দিতে হলো। তখন বাসায় বসে ভাবতে থাকি এত পড়াশোনা কেন করলাম? যদি কিছু নাই করতে পারি! আর যখন কোর্টে প্র্যাকটিস করতাম তখন নির্যাতিত, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের দেখে খুব কষ্ট লাগত। তাদের জন্য কিছু করার এবং অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোর খুব ইচ্ছা ছিল। সেই চিন্তা থেকেই এই নারীদের নিয়ে হস্তশিল্পের কাজ শুরু করি। এই সময় আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় এবং করোনাকালে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু আমি আমার বিজনেসটাকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু বিজনেস সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিল না। তাই করোনাকালে অনলাইন ঘেঁটে ‘ই কমার্স’ সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্রেনিং নেওয়া শুরু করি। সর্বশেষ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অন দ্য জব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১২ দিনব্যাপী খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসা পরিচালনার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করি। এ ছাড়া জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) লেভেল থ্রি প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছি। 
তিনি আরও জানান, ‘যেহেতু আমি রান্না করতে ভালোবাসি এবং আমার রান্না অনেকেই পছন্দ করেন- সেই ভাবনা থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। রান্নার কাজ করতে গিয়ে দেখলাম-মানসম্মত মসলার অভাবে খাবারের মানে হেরফের হচ্ছে। এ সময় আমি গুঁড়া মসলা নিয়ে কাজ শুরু করি। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় খাদ্যপণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করি। এখন আমি বাড়িতেই মরিচ, হলুদ, জিরা, মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের গুঁড়া মসলা তৈরি, বিট রুট পাউডার, স্পেশাল শাহী মসলা তৈরি করি। এছাড়া আমার নিজের ক্রিয়েটিভিটি থেকে স্পেশাল মিক্সড বেসন, রেডি টু মিক্স হালিম, পিঁয়াজু মিক্স, কুমড়োর বড়ি ইত্যাদি তৈরি করছি। ৪/৫ জন নারী কর্মী আমার এই কাজে যুক্ত রয়েছে। এছাড়া অন দ্য জব প্রশিক্ষণের পর আমার উদ্যোগের সাথে নতুন করে যুক্ত করি ব্যতিক্রমী খাদ্যপণ্য টমেটো পাউডার, কাঁচামরিচের গুঁড়া, সরিষা পাউডার, বেগুনের আচার, সবজির আচার, বিভিন্ন জ্যাম জেলি ইত্যাদি। অনলাইনে ‘নান্দনিক ফুড অ্যান্ড এগ্রো’ পেজ থেকে এসব পণ্যের বেচাকেনা হচ্ছে। এর পাশাপাশি হস্তশিল্পের পণ্যও রয়েছে। এই কাজ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকার উপার্জন হয়। এখন একটি আউটলেট স্থাপনেরও উদ্যোগ নিচ্ছি।’
ইয়াসমিন সুলতানা ইতোমধ্যে ‘অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নারী’ হিসেবে জয়িতা সম্মাননা এবং যুব উন্নয়নের সম্মাননাও পেয়েছেন। তার স্বপ্ন তুলে ধরে বলেন, এখন আমি আমার উদ্যোগকে শুধু দেশের মধ্যে নয়, দেশের বাইরেও ব্র্যান্ড হিসেবে প্রসার ঘটাতে চাই। বর্তমানে আমার উৎপাদিত বিট রুট পাউডার এবং স্পেশাল মিক্সড বেসন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমার স্বপ্ন আমার উদ্যোগ একদিন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পৌঁছে যাবে।’
ইয়াসমিন সুলতানার স্বামী যশোর সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক আরিফুর রহমান জানান, ‘ইয়াসমিনের রান্নার হাত বরাবরই ভালো। এ কারণে খাদ্যপণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে সে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। তার স্বপ্ন তার খাদ্যপণ্য ব্র্যান্ড হিসেবে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। সেই স্বপ্ন পূরণে সে নিরলসভাবে কাজ করছে।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে যশোরে ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার-ডিএএম অঙ্গ)’ শীর্ষক প্রকল্পে তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে প্রিজম এগ্রো অ্যান্ড ফুড’।
প্রিজম হোটেল ম্যানেজমেন্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান বশির আহমেদ চন্দন জানান, দেশব্যাপী বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের মধ্যে কৃষি ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের বিকাশকে উৎসাহিত করতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তারা নিবিড়ভাবে এই তরুণ উদ্যোক্তাদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন।   
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যশোরের সিনিয়র কর্মকর্তা কিশোর কুমার সাহা বলেন, শুধু ইয়াসমিন নন; এমন অসংখ্য উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়িয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় অন দ্য জব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। যার ফলে এসব উদ্যোক্তা যেমন পেয়েছেন কারিগরি জ্ঞান তেমনি পেয়েছেন ব্যবসা পরিচালনা ও আইনগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। পরবর্তীতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, যশোর থেকে এই উদ্যোক্তাদের সার্বক্ষণিক নার্সিং করা হচ্ছে। এর ফলে একাধিক উদ্যোক্তা তাদের কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আগামী ২০২৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই অন দ্য জব প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।

প্যানেল

×