ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নারীর মানবিক বলয়

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ১২ জুন ২০২৫

নারীর মানবিক বলয়

সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নারী-পুরুষের ন্যায্যতা, পাওনা, অধিকার, স্বাধীনতা যথার্থ মানবিক বলয়ের বিষয়। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিত্ত-নির্বিত্তের ফারাকই শুধু নয় আভিজাত্যের গৌরব, সম্মান-মর্যাদার আবেদন-নিবেদন সব সময় এক ও অভিন্ন অবস্থায় থাকেই না। সবার আগে দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান নারী-পুরুষের ভিন্নতা, অসমতা আর লড়াইয়ের অনন্য পালাক্রম। যা আজও শেষ না হওয়াও চিরস্থায়ী দুর্ভোগ। যে কোনো সমাজ-সংস্কারের মানবিক মূল্যবোধ নির্দিষ্ট আঙিনার সার্বজনীন হওয়া আবশ্যক। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে তার উল্টো অবস্থাই সিংহভাগ মানুষের মধ্যে পাহাড়- সব ব্যবধান তৈরি করে। নারীর মানবাধিকার বাস্তবতা আর তার অন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াও পরিবেশের চাহিদা। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী বিভেদ-বিভাজনের যে অপকৌশল তা কোনোভাবেই আইনানুগ তো নয়ই মান্যতাও পায় না। রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক অধিকারে তেমন কোনো ব্যত্যয়ও পরিলক্ষিত হয়ই না। যথার্থ নিয়মের মধ্যে অনিয়মের যে শিকড় সেটা সমাজ সংসারকে নানামাত্রিকে প্রভাবিত করে। সামাজিক বিশৃঙ্খলার অবতারণা হয়। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পদে পদে লঙ্ঘিত হয় যা কি না সার্বিক কাঠামোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অপেক্ষাকৃত কমনীয় আর শারীরিকভাবে কোমল নারীরা আঙ্গিকে, বৈশিষ্ট্যে পুরুষের সমকক্ষ না হলেও শুধু মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কোনো কার্পণ্য করা হয়। অথচ এই নারীর দেহ-মনেই সৃষ্টির রহস্য, দ্যোতনা আবার নারীই সৃজন-মনন শৌর্যে সমাজ সংস্কারের নিয়ামক শক্তি। বিভিন্ন নারী সংগঠন বিশেষ করে মহিলা পরিষদ আর রাজনৈতিক সংগঠনের নারীরাও প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সামাজিক, পারিবারিক আর ব্যক্তিগত স্বাধিকারের পর্যায়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও বাস্তব প্রেক্ষাপট বিপরীত স্রোতধারায় বহমান। সেই বিশ্ব সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি ফারাক-তারতম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট সমসংখ্যক নারী আধুনিক বলয়েও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। এমনিতে চলার পথ নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন থাকেই না। যত্রতত্র হেনস্তার শিকার, নির্যাতন, লাঞ্ছনার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া নারীরা কোথায় যে নিরাপদ তা প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় চলার পথের চরম সংকট। ক্ষুদ্র পারিবারিক আঙিনা, অবকাশে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া, বিদ্যালয়গামী বালিকা আর কিশোরীরা পবিত্র শিক্ষাঙ্গনেও নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকে বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নারী-বিষয়ক সমস্যাসঙ্কুল অবস্থা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেটাও সুস্থতা, সুখকর কিংবা নির্বিঘ্ন যাত্রা পথে যেন কাঁটা, পাথর ছড়ানো গতিপথ শুধু বাধাগ্রস্তই নয় কণ্টকিত হতেও সময় নেয় না। এমন সময় খুবই কম দৃশ্যমান হয় যেখানে নারীরা স্বাভাবিক, নিষ্কণ্টক যাত্রাপথকে সাবলীল আর স্বাচ্ছন্দ্য করতে পারে। গণমাধ্যম তোলপাড় হয় নারীর প্রতি হরেক লোমহর্ষক মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। সেখানে কন্যা শিশু থেকে উদীয়মান তরুণী, যুবতী, বয়স্ক যে কোনো নারীর নিরাপত্তার বলয় যে কতখানি দুর্বল তা প্রকাশ পেতেও দেরি হয় না। নারীরা মায়ের জাত সর্বংসহা জননীর আসনে অভিষিক্ত, অলঙ্কৃত। আবার দেশপ্রেমের সার্বিক অংশ জুড়েই থাকে মাতার সার্বজনীন মাহাত্ম্য। দেশকে মাতৃভূমির গৌরব, সৌরভে আবৃত করা যেন মায়ের চিরায়ত বন্দনায় দেশপ্রেমের অকৃত্রিম নিষ্ঠা আর নিবেদনের পরম স্মৃতিও বলা যায়। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত প্রদানের যে মহিমা ঝঙ্কৃত হয়েছে সেটাও গর্ভধারিণী জননীর অভাবনীয় শৌর্য। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ও নারী শক্তির বন্দনায় পূজা পার্বণে যে, সমর্পণ নিবেদন সেটাও তো মাতৃরূপের নানামাত্রিক অর্চনা, একেবারে সার্বিকভাবে বিলিয়ে দেওয়ার মতোই। তাই দশভুজা দুর্গার যে সংহার এবং সত্যনিষ্ঠ অবয়ব তাও যুগে যুগে অসুরে বিনাশই নয়। তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠা আর পরম সুন্দরের চিরস্থায়ী নির্মাল্যও অর্থাৎ শুধু আইন, সংবিধান নয় বিভিন্ন ধর্মও নারীকে যে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে সেখানে প্রচলিত সংস্কার, পুরানো বিধিনিষেধ আর সামাজিক চিরস্থায়ী গোঁড়ামি, বন্ধনজাল থেকে কেন যে মুক্তি পাচ্ছে না তা সত্যিই বলা কঠিন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সমসংখ্যক নারী শিক্ষায়, নিত্য নতুন বৈচিত্র্যিক পেশায় সম্পৃক্ত হলেও সেখানে যে কত বিপদ-বিপত্তির জাঁতাকলে পড়তে হয় তা পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকছেই না। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক বলয়ে অবরুদ্ধতার জালে আটকানো সমসংখ্যক নারী কবে যে সব বন্ধন জাল ছিন্ন করতে পারবে। কবে তারা মানবিক, রাষ্ট্রিক, আইনি অধিকারকে নিজেদের আয়ত্বে আনতে পারবে তাও এক দুর্গম, কণ্টকাকীর্ণ পথের অনধিগম্য যাত্রা। সবশেষে উল্লেখ করতে চাই সম্প্রতি জুলাই অভ্যুত্থানে হয়ে যাওয়া বৈপ্লবিক আন্দোলনে ছাত্রীদের সংখ্যা কোনোভাবেই অপ্রতুল ছিলই না। সবাই মিলে মিশে কাঁধে কাঁধ রেখে একাত্ম হয়ে আন্দোলনকে সফলতার আলো দেখায়। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সেই বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রীদের অবদানকে যথার্থভাবে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করছে বলে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আপত্তি  আর অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এখনো তার বিরাম-বিরতি নেই। সব দোষ কি কাঠামোগত পিতৃতান্ত্রিকতা? নাকি সার্বিক সমাজ ব্যবস্থার শিকড়ে কিছু বিভাজন তো চাপা পড়ে আছে। সেখানেই সজোরে আঘাত করা নারী-পুরুষের মিলিত দায়বদ্ধতা। 

প্যানেল

×