ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সৌদি খেজুরে স্বপ্ন বুনছেন শোকর আলী, সাতক্ষীরার মাটিতে মিলছে মরু ফলের স্বাদ

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৬:৫৫, ১২ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৬:৫৬, ১২ জুন ২০২৫

সৌদি খেজুরে স্বপ্ন বুনছেন শোকর আলী, সাতক্ষীরার মাটিতে মিলছে মরু ফলের স্বাদ

সাতক্ষীরা জেলার এক প্রান্তে, কালীগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের নিরিবিলি এক গ্রামে গড়ে উঠেছে ‘খেজুরবাড়ি’ নামে পরিচিত একটি নার্সারি। সেখানে ছোট ছোট গাছে সৌদি খেজুরের ঝুলন্ত থোকা দেখে বিস্মিত হচ্ছেন পথচারী, আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। আর এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে রয়েছেন এক নিরহংকারী প্রবাসফেরত কৃষক—শোকর আলী।

এক সময় জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরব গিয়েছিলেন শোকর আলী। পরিবার-পরিজনের মুখে হাসি ফোটানোর আশায় দীর্ঘ ছয় বছর পরিশ্রম করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের খেজুরবাগানে। কিন্তু ভাগ্যের সহায়তা পাননি। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দেয়নি। অবশেষে খালি হাতে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। তবে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এমন কিছু, যা তাঁর ভবিষ্যতের চেহারা বদলে দেবে—সৌদি আরবের মরিয়ম জাতের খেজুরের বীজ এবং খেজুর চাষের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

দেশে ফিরে নিজের ১৫ কাঠার বসতভিটার মধ্যে ১২ কাঠা জমিতে তিনি রোপণ করেন সেই খেজুরবীজ। যত্ন আর অধ্যবসায়েই বীজ থেকে চারা হয়, গাছ বড় হয়, এবং চার বছরের মাথায় একটি গাছে ধরে সাতটি থোকা খেজুর। প্রতিটি থোকা প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের। গাছটি উচ্চতায় মাত্র পাঁচ ফুট হলেও ফল এসেছে ঘন এবং ভারী। খেজুরের ভারে থোকাগুলো ঝুঁকে পড়েছিল মাটির দিকে, সেগুলোকে ধরে রাখতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বিশেষভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে।

শোকর আলীর এই সাফল্য আজ শুধু তাঁর পরিবারকেই স্বস্তি দেয়নি, বরং আশপাশের এলাকা এবং জেলার বহু কৃষককে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। স্থানীয়রা এখন তাঁর বাড়িটিকে ভালোবেসে ‘খেজুরবাড়ি’ বলেই ডাকে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে দেখে যাচ্ছেন সৌদি খেজুরের চারা, ফল এবং শুনে যাচ্ছেন শোকর আলীর গল্প।

তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, নীল রঙের জালে ঘেরা শত শত খেজুরগাছের চারা সাজানো। উঠোনে বসে নিজ হাতে চারা প্রস্তুত করছেন শোকর আলী। সেখানে উপস্থিত একজন আগ্রহী ক্রেতা মো. মূসা জানান, তিনি পেশায় মাছচাষি। খেজুরগাছের এমন ফলন দেখে তিনি নিজের প্রকল্প এলাকায় রোপণের জন্য ২১টি চারা কিনেছেন। তাঁর ভাষায়, “প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম, এমন গরমের দেশে খেজুর হবে না। কিন্তু এখন দেখে আমি নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠেছি।”

শোকর আলী বলেন, “যে অভিজ্ঞতা আমি সৌদি আরবে খেজুরবাগানে কাজ করতে গিয়ে অর্জন করেছি, সেটা এখন কাজে লাগাতে পারছি। আল্লাহর রহমতে প্রথম ফল এসেছে, আগামীর দিনগুলোতে আরও ভালো ফলনের আশা করছি।”

তাঁর কথায় উঠে আসে আরেকটি তথ্য—বর্তমানে তাঁর নার্সারিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৬ হাজার খেজুরের চারা রয়েছে। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৮০০ টাকায়, আকার ও বয়সভেদে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তিনি ইতোমধ্যে আরও দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন নার্সারি সম্প্রসারণের জন্য।

সৌদি মরিয়ম জাতের এই খেজুর চাষে বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন নেই বলেই জানালেন তিনি। দেশি ফলদ গাছের মতোই পরিচর্যা করলেই হয়। প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ১২০টি গাছ রোপণ করা যায়। তবে প্রথম দুই বছর গাছে ফল আসলে তা কেটে ফেলতে হয়, যাতে গাছ শক্ত ও উচ্চতায় বড় হয়। তিন বছরের পর গাছে স্থায়ীভাবে ফল আসে। তিন মাসের মধ্যেই খেজুর পেকে যায়।

বর্তমানে শোকর আলী যে গাছে ফল পেয়েছেন, তার খেজুর পাকতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন লাগবে বলে তিনি ধারণা করছেন। এরপরই তিনি নিজের উৎপাদিত প্রথম খেজুর বাজারে ছাড়তে পারবেন।

এখনো পর্যন্ত এ ধরনের সৌদি খেজুর চাষ বাংলাদেশে খুব বেশি দেখা যায়নি। তাই কৃষি কর্মকর্তারাও বিষয়টি আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওয়াসীম উদ্দীন জানান, “খেজুরটি আসলেই মরিয়ম জাতের কিনা, তা এখনো ল্যাব টেস্টে যাচাই করা হয়নি। তবে যেহেতু ফল এসেছে, সেটি খুবই আশাব্যঞ্জক। আমরা ইতোমধ্যে খোঁজখবর নিচ্ছি। পরীক্ষামূলকভাবে ভবিষ্যতে এই জাতের চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে।”

প্রবাসে ফিরে না পাওয়া সাফল্য আজ নিজের মাটিতেই খুঁজে পেয়েছেন শোকর আলী। যে গাছটি একদিন শুধু পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রোপণ করেছিলেন, সেটিই এখন আশার আলো দেখাচ্ছে। তাঁর খেজুরবাড়ি এখন শুধু নার্সারি নয়—এটি পরিণত হয়েছে এলাকার কৃষকদের শেখার একটি মডেল ফার্মে। খেজুরের ছায়ায় স্বপ্ন দেখছেন তিনি, দেখাচ্ছেনও অন্যদের।

শোকর আলী বলেন, “চেষ্টা থেমে নেই। আল্লাহ চাইলে এখান থেকেই আমি আবার উঠে দাঁড়াতে পারব। আর শুধু আমি নই, অনেকে এই গাছ থেকে উপকার পাবে—এটাই আমার বড় সান্ত্বনা।”

সজিব

×