
মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী ও মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় পরিপূর্ণ ঋদ্ধ দৈনিক জনকণ্ঠের প্রয়াত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় আতিকউল্লাহ খান মাসুদের মহাপ্রয়াণে প্রণীত হয়েছে শোকাহত জাতির ধূসর প্রতিভাস। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শুধু শুদ্ধতম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন না, গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের অত্যন্ত সফল একজন উদ্যোক্তা চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্বমহিমায়। আকস্মিক না ফেরার দেশে অসময়-দুঃসময়-দেশের ক্রান্তিকালে তাঁর চলে যাওয়া বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের হৃদয়ে সীমাশূন্য শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বিবেক-আবেগ-দেশপ্রেমে পরিশুদ্ধ মার্গশীর্ষ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের প্রণিধি অভিভাবক ও অফুরন্ত উদ্ভাবনী দীপনে কৃতাহ্নিক উন্নয়ন প্রকৌশলী এই মহান ব্যক্তির তিরোধানে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনে পর্যাপ্ত ভাষাশৈলী আবিষ্কার সত্যিই দুরূহ। তবুও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্মরণ’ কবিতার পঙ্্ক্তি নিবেদনে অবিস্মৃত এই মহাত্মার প্রণত বিদায়ভুবন রচনা করতে চাই- ‘যখন রব না আমি মর্তকায়ায়/ তখন স্মরিতে যদি হয় মন,/ তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়/ যেথা এই চৈত্রের শালবন।/...সেদিন ভুলিয়াছিনু কীর্তি ও খ্যাতি,/ বিনা পথে চলেছিল ভোলা মন;/ চারিদিকে নামহারা ক্ষণিকের জ্ঞাতি/ আপনারে করেছিল নিবেদন।/...সেদিনের হারা আমি, চিহ্নবিহীন/ পথ বেয়ে কোরো তার সন্ধান-/ হারাতে হারাতে যেথা চলে যায় দিন,/ ভরিতে ভরিতে ডালি অবসান।’
গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-জ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ক্ষুরধার লেখনী এবং লেখক সৃষ্টি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন-দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম-মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠোদ্ধারে অবর্ণনীয় শিক্ষা-সচেতনতা প্রচার-প্রসারে তাঁর অবদান ছিল অতুলনীয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নত বিশ্বের মর্যাদায় সমাসীন হওয়ার অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির অভিযাত্রায় জনকণ্ঠ ও সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন জনাব মাসুদের নির্ভীক-সাহসিক-দৃঢ়চেতা ভূমিকা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিকশিত করার সকল পদক্ষেপই ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
গণবিচ্যুত গণমাধ্যম অপসংস্কৃতির নষ্ট ধারাকে বিশ্বময়তাদানে উন্নয়নশীল বিশ্বকে কতটুকু নির্মমভাবে প্রভাবিত ও দুর্বৃত্তায়নের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারদর্শী, সচেতন বিশ্বজনীন মানবতাবাদী বিবেকবান মানুষের বোধে তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। প্রসঙ্গত মহাত্মা গান্ধীর অমিয় মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই- ‘আমি আমার ঘরটিকে চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত ও আমার জানালাগুলো বন্ধ রাখতে চাই না। আমি চাই সকল দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরের চারপাশে যত ইচ্ছা স্বাধীনভাবে এসে ভিড় করুক। কিন্তু তার কোনটি আমাকে স্থানচ্যুত করবে সেটা আমি হতে দেব না।’ প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা, ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ, জ্ঞান আহরণ-বিতরণ ও সৃজনের প্রতীকী প্রকৃতি-প্রবাহ এবং পরিকর্ষ মানদ-ে এর প্রায়োগিক বিনিময় আজকের দিনে গান্ধীজীর অমূল্য মন্তব্য কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, দীপ্যমান সচেতন অনুধাবনে পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ তাঁর প্রতিটি কর্মযজ্ঞে অবিস্মরণীয় ও যুগান্তকারী পরঞ্জয় ব্যঞ্জনা প্রতিস্থাপন করে গেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে অতি স্বল্পসংখ্যক গণমাধ্যম এবং গুটিকয়েক ব্যক্তি সাংবাদিক মুখোশধারী অপসাংবাদিকতায় লিপ্ত থেকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রহনন, সরকারী-বেসরকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নানাবিধ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা-বিদ্বেষমূলক-প্রতিশোধপরায়ণ হয়রানির নিকৃষ্টপন্থা অবলম্বন করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে ব্যতিব্যস্ত থাকে। হিংস্র বন্যপশুর রক্তপ্রবাহে যেন এদের জন্মরহস্য নির্ধারিত। অপরিমেয় অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাবলিপ্সু মেধাশূন্য ও অযোগ্যতায় প্রতনু অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী পদ-পদক-পদবি আদায়ে নির্লজ্জ ছলচাতুরী-প্রতারণায় অভ্যস্ত ঘৃণ্য-নপুংসকদল এসব কথিত কবি-সাংবাদিক-কলামিস্ট-প্রাবন্ধিকগোষ্ঠী প্রণোদিত এবং প্রণমিত সহায়তাপ্রাপ্ত হয়ে তাদেরই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে পবিত্র সাংবাদিকতা-গণমাধ্যম জগতকে বিশ্বব্যাপী করছে নিদারুণ অপবিত্র ও কলুষিত। প্রাণপ্রিয় মাসুদ ভাই উল্লিখিত অপসাংবাদিকতাকে সংহার করে তৌর্যত্রিক তথ্যপ্রবাহ ও জাতিরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গণমাধ্যমের পবিত্রতা সমুন্নত রেখেছেন।
প্রাসঙ্গিকতায় বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল প্রাইজ প্রণেতা আলফ্রেড নোবেলের অমূল্য বাণী উত্থাপন করছি। তিনি পরিহাস করে নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোন ডাক্তারের উচিত ছিল জন্ম মুহূর্তে তাঁর শোচনীয় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ- তিনি অর্থলোলুপ ছিলেন না।’ এই কঠিন সত্যকে যাঁরাই ধারণ করছেন তাঁরাই প্রতি মুহূর্তে সমকক্ষতা পরাভূত ব্যক্তি-গোষ্ঠীসৃষ্ট নির্মম সঙ্কটে নিপতিত হচ্ছেন। এই বিপ্রতীপ সংশ্লেষ পুরো সমাজকেই বিপন্ন নির্বন্ধতায় আলোকনিবারিত করে তুলছে। এই যুগসন্ধিক্ষণে বিপরীত স্্েরাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রয়াত সম্পাদক প্রাণপ্রিয় মাসুদ ভাই গণমাধ্যমের সত্যনিষ্ঠ লেখনী, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, মনন-সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ তারুণ্যের অদম্য সক্ষমতার অবগাহনে এক আধুনিক যুগের প্রত্যাবর্তন সংস্কৃতির উৎসমূলে প্রাণসঞ্চার করে বাঙালী জাতিরাষ্ট্রে সুশাসনের সংসর্গ প্রণোদিত করেছেন।
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সত্য-বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ-বিনিময় ব্যবস্থাপনায় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হওয়ার বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সংবাদপত্রকে জনগণের অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধি এবং জনমত গঠনে সাংবাদিকদের বিবেকপ্রসূত কর্মযজ্ঞকে বিবেচনায় নিয়ে গণমাধ্যমকে ফোর্থ ইস্টেইট বা চতুর্থ রাষ্ট্র সম্পদ বিশেষণে ভূষিত করে। ভৌগোলিক সীমারেখা নির্বিশেষে সকল ধরনের নষ্ট সাংবাদিকতাকে পরিহার করে সুষ্ঠু সাংবাদিকতায় পরিপুষ্ট দৈনিক জনকণ্ঠ সংবাদ মাধ্যমকে মনুষ্যত্ব-মানবিকতার সেবা-পরিচর্যার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচনায় ইতোমধ্যেই প্রকৃষ্ট পরিচায়ক হয়েছে।
অশুভ-অন্ধকারের শক্তির কূট কৌশলে দেশকে অনর্থক অস্থিতিশীল-দেশের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি- দেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার কূটচাল-অপকৌশল প্রতিহত-প্রতিরোধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মহোৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণে জনকণ্ঠ সম্পাদক মাসুদ ভাইয়ের অনুপস্থিতি যারপরনাই যন্ত্রণাকাতর ও হৃদয়বিদারক। দেশের আপামর জনসাধারণের অন্তরে ধারণকৃত অত্যন্ত সজ্জন, বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি মহত্ত্ব-মমত্বে পরিপুষ্ট কৃতিমানব মাসুদ ভাইয়ের অন্তিমযাত্রা করুণ সানাইয়ের সুরের মতো দেশের প্রতিটি জনপদে প্রতিনিয়ত অনুরণিত হচ্ছে। মাসুদ ভাইয়ের চিরস্মরণীয়-চিরঅম্লান স্মৃতি কখনও বাংলার ইতিহাস থেকে নির্বাসিত হওয়ার নয়। জাতীয় কবি নজরুলের ‘সত্যকবি’ কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণে নিঃসঙ্কোচে বলা যায় তিনি কালান্তরের কবি-শব্দ সৈনিক-চিরঞ্জীব উন্নয়নযোদ্ধা হিসেবে যুগ যুগ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। ‘অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য সে গেল চ’লে/ বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ’লে।/ যে ভোরের তারা অরুণ-রবির উদয়-তোরণ-দোরে/ঘোষিল বিজয়-কিরণ-শঙ্খ-আরাব প্রথম ভোরে,/ রবির ললাট চুম্বিল যার প্রথম রশ্মি-টীকা,/বাদলের বায়ে নিভে গেল হায় দীপ্ত তাহারি শিখা!/ মধ্য গগনে স্তব্ধ নিশীথ, বিশ্ব চেতন-হারা,/ নিবিড় তিমির, আকাশ ভাঙিয়া ঝরিছে আকুল-ধারা,/ গ্রহ শশী তারা কেউ জেগে নাই, নিভে গেছে সব বাতি,/ হাঁক দিয়া ফেরে ঝড়-তুফানের উতরোল মাতামাতি !’ অচিরেই বাঙালী এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার প্রত্যয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন- এই প্রত্যাশ ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়