ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র বাকিদের জন্য পুঁজিবাদ

প্রকাশিত: ২০:১৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র বাকিদের জন্য পুঁজিবাদ

মূল : টমাস এল ফ্রিডম্যান রূপান্তর : এনামুল হক ডেমোক্র্যাটরা কেন ফুঁসছে বুঝতে পারছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প কর হ্রাস, সামরিক ব্যয় ও অল্পবিস্তর আর্থিক শৃঙ্খলার দ্বারা তার প্রথম তিন বছরের বাজেট ঘাটতিকে মার্কিন ইতিহাসের সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা কেবল বড় ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ ও আর্থিক সঙ্কটের সময়েই দেখা গিয়েছিল। আর সেটা তিনি করেছিলেন করোনা মহামারী দেখা দেয়ার আগে যখন অর্থনীতির ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছিল এবং বেকারত্বের হার ছিল কম। কিন্তু এখন জো বাইডেন যেখানে মহামারী পরিস্থিতিতে ত্রাণ সাহায্য প্রদানে আরও অর্থ ব্যয় করতে এবং অর্থনীতির আরও অধঃপতন রোধ করতে চাইছেন, সেখানে অনেক রিপাবলিকান একদম মোক্ষম সময়ে উপলব্ধি করছেন, তাদের যে কোন মূল্যে সুষম বাজেট প্রয়োজনÑ অর্থাৎ সরকারের ব্যয় যেন হ্রাস করা হয়। কি ধরনের ভণ্ডামি! কোভিড-১৯-এর কারণে চাকরি-বাকরি, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে বসা সর্বাধিক বিপন্ন আমেরিকানদের সাহায্য করা এবং ভাইরাসে বিপর্যস্ত নগরীগুলোতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করার জন্য আমাদের যত অর্থ লাগে লাগুক, ব্যয় করা প্রয়োজন। কাজেই এত বদান্যতা দেখানোর চেষ্টায় বাগড়া দিতে হবে। তবে তবে, তবে...এই ভাইরাস বিদায় নেয়ার পর আমাদের সবারই আলোচনায় বসা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত বিশ্বায়নের মন্দ দিকগুলো এবং ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয়ের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী ‘নব্য উদার মুক্ত-বাজার গোষ্ঠীচিন্তার’ ওপর এত বেশি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে যে, আমরা উভয় দলের ওপর গেড়ে বসা আরেকটি এবং অধিক শক্তিশালী ঐকমত্যকে উপেক্ষা করেছি। সেটা হলো এই যে, আমরা চিরস্থায়ীভাবে কম সুদের হারের এক নতুন যুগে রয়েছি। কাজেই ঘাটতি বাজেটে কিছু যায় আসে না, যতক্ষণ সেই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়া যায়। আর সে কারণেই উন্নত দেশগুলোতে সরকারের ভূমিকার সম্প্রসারণ ঘটে চলতে পারে। সেখানে রয়েছে সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়ার ক্রমাগত ব্যবস্থা, একটানা ঘাটতি ব্যয়, ক্রমবর্ধমান সরকারী ঋণ এবং সেই ঋণের অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান সহজে অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থা। এই নতুন ঐকমত্যের একটা নাম আছে। সেটা হলো ‘ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র এবং বাকিদের জন্য পুঁজিবাদ’। কথাটা বলেছেন মরগান স্ট্যানলি ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টের চীফ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস্ট রুচির শর্মা। ‘দ্য টেন রুলস অব সাকসেসফুল নেশনস’ গ্রন্থের এই লেখক আমার প্রিয় বিপরীতধর্মী অর্থনৈতিক চিন্তাবিদদের একজন। ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র ও বাকিদের জন্য পুঁজিবাদ- এটি হলো ১৯৬০-এর দশকে জনপ্রিয়তা পাওয়া একটি বিষয়ের ভিন্ন এক প্রকরণ। এক টেলিফোন সাক্ষাতকারে শর্মা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র ও বাকিদের জন্য পুঁজিবাদ তখনই ঘটে, যখন সরকারের হস্তক্ষেপে প্রকৃত অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার বদলে অর্থলগ্নী বাজারগুলোকেই বেশি করে উদ্দীপিত করে তোলা হয়। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারের মালিক সর্বাধিক ধনী ১০ শতাংশ আমেরিকানের সম্পদ ৩০ বছরে হয়েছে তিনগুণেরও বেশি। অন্যদিকে আয়ের দিক দিয়ে সর্বনিম্নে যাদের অবস্থান, সেই ৫০ শতাংশ আমেরিকান যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃত বাজারের দৈনন্দিন কাজের ওপর নির্ভর করে থাকে, তাদের এ সময়ে অর্জিত হয়েছে শূন্য। এদিকে প্রকৃত অর্থনীতির মাঝারি স্তরের উৎপাদনশীলতার কারণে গরিব ও মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে সকলের সীমিত সুযোগ, বিকল্প ও আয়গত সুফল রয়েছে। এর সর্বোত্তম প্রমাণ হচ্ছে বিগত বছর। মহামারীর মাঝামাঝি অবস্থায় থাকার সময় আমাদের চাকরি-বাকরি ও ছোটখাটো ব্যবসায়ে ধস নেমে আসে। কিন্তু শেয়ারবাজারে শেয়ারের দাম বেড়ে চলে। সেটা সঙ্গত নয়। এ হলো হাতির আকাশে উড়ে চলা। হাতিদের উড়তে দেখলে আমি সর্বদাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। কারণ সচরাচর এর পরিণতি ভাল হয় না। শর্মার বক্তব্য হলো, আমরা যদি ধনিক শ্রেণীর ওপর কর বাড়াই এবং গরিবদের জন্য আরও ত্রাণ সহায়তা প্রদান করি যার পক্ষপাতী আমি নিজে, তারপরও এই পরিমাণ প্রণোদনার ওপর নির্ভর করে চললে বেশ কিছু অনভিপ্রেত পরিণতির সম্মুখীন হতে হয় এবং আমরা ঠিক তাই করছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, শর্মা জুলাই মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ‘দ্য রেসকিউস রুয়িনিং ক্যাপিটেলিজম’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, সহজলভ্য অর্থ এবং কর্মবর্ধমান উদার বেইল আউট ব্যবস্থা মনোপলি বা একচেটিয়া কারবারের উত্থানে ইন্ধন জোগায় এবং উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি স্টার্টআপ বা নবাগত কোম্পানিগুলোর সর্বনাশ ঘটিয়ে বিপুল ঋণে ভারাক্রান্ত ‘জোম্বি’ কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। এসব কিছুর পরিণামে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তার অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ে এবং ‘প্রত্যেকের ভাগের অংশ সঙ্কুচিত হয়ে আসে।’ সে কারণেই কারও অবাক হওয়া উচিত নয় যে, ‘মিলেনিয়ালস (অর্থাৎ ১৯৮০-এর দশকের প্রথমভাগ এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষ ভাগের মধ্যে জন্ম নেয়া প্রজন্ম) এবং জেনারেশন জেড (অর্থাৎ ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ২০১০-এর দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত জন্ম নেয়া তরুণ-তরুণীর প্রজন্ম) পুঁজিবাদের এই বিকৃত রূপ দেখে মোহমুক্ত হয়ে উঠছে এবং বলছে যে, তারা বরং সমাজতন্ত্রই পছন্দ করে।’ এসব কিছুই যৌক্তিক। শর্মা লিখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ও ক্রমবর্ধমান হারে উদারহস্তে বেইল আউটের ব্যবস্থা থাকায় যেখানে সরকারগুলো কোম্পানির বন্ধ হওয়া ঠেকাতে কর্পোরেট জাঙ্ক বন্ড পর্যন্ত কিনতে ইচ্ছুক থাকে, সেখানে ‘এমন ব্যবস্থা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মূলধনের দক্ষ বরাদ্দকে বিকৃত করে দেয়।’ গত কয়েক বছর বিশাল পরিসরে সৃজনশীল ধ্বংসের যুগ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত ছিল। আবিষ্কারও উদ্ভাবনের এত বেশি সংখ্যক সস্তা নতুন ডিজিটাল হাতিয়ার থাকায়, উচ্চশক্তির সস্তা কম্পিউটিংয়ের বেশি সুযোগ থাকায় এবং বেশি সহজলভ্য অর্থ থাকায় স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। শর্মা লিখেছেন, ‘করোনা মহামারীর আগে যুক্তরাষ্ট্র অন্ততপক্ষে ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে মন্থরতম হারে স্টার্টআপ কোম্পানি সৃষ্টি করছিল এবং সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ট্রেড কোম্পানির সংখ্যা ১৯৯৬ সালে তুঙ্গে ওঠার পর থেকে প্রায় অর্ধেকে নেমে ৪৪০০-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল।’ (মহামারীর সময় স্টার্টআপ কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে সেটা অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়ত হয়েছিল)। সহজলভ্য অর্থ এবং সুদের স্বল্প হারের এই যুগে বৃহৎ কোম্পানিগুলো বিশাল আকার ধারণ করছে এবং একচেটিয়া রূপ পরিগ্রহ করছে। ইন্টারনেট সৃষ্ট ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী যে বিজয়ী হবে, সেই সমস্ত বাজার দখল করে নেবে। এই ব্যবস্থার কারণে এ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক ও এ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলোর পক্ষে নগদ অর্থের এমন মজুদ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, যা অনেক রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চেয়েও বেশি। এই ব্যাপারটা শুধু যে ইন্টারনেট সৃষ্ট ব্যবস্থার জন্যই হয়েছে তা নয়। এ কারণেও হয়েছে যে, এই কোম্পানিগুলো তাদের স্ফীত শেয়ারমূল্য বা নগদ অর্থের মজুদকে অতি সহজে কাজে লাগিয়ে উদীয়মান প্রতিযোগীদের কিনে নেয় এবং সমস্ত মেধা ও সম্পদকে গ্রাস করে নিয়ে খুদে উদ্যোক্তাদের পথে বসায় বলে উল্লেখ করেছেন শর্মা। তিনি আরও বলেন, এদিকে সরকারগুলো যখন মন্দা দূর করার জন্য উদ্যোগী হচ্ছে, তখন মন্দা আর অর্থনীতি থেকে অদক্ষ কোম্পানিগুলোকে বের করে দেয়ার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে এবং উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে কম। সুতরাং প্রবৃদ্ধিকে মেধা দিয়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিবার অধিক থেকে অধিকতর প্রণোদনা বা উদ্দীপনার প্রয়োজন হচ্ছে। এসব কিছুর কারণে প্রকৃতপক্ষে আমাদের ব্যবস্থাটি অধিকতর ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এত বেশি সংখ্যক দেশ তাদের ঋণের বোঝা বিশাল আকারে বাড়িয়ে তুলেছে যে, মুদ্রাস্ফীতির সামান্য মাথাচাড়া দেয়ার কারণেও যদি ১০ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ১ শতাংশ থেকে লাফ মেরে ৩ শতাংশে পৌঁছায় তাহলে সুদসহ ঋণ পরিশোধে যুক্তরাষ্ট্রকে যে পরিমাণ অর্থ নিয়োগ করতে হবে তা হবে এতই বিশাল যে গবেষণা, অবকাঠামো বা শিক্ষা খাতে ঐচ্ছিক ব্যয় করার মতো হয়ত সামান্য অর্থই থেকে যাবে। নিশ্চয়ই আমরা তখন আরও বেশি কাগজী মুদ্রা ছাপাতে পারি। কিন্তু তাতে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের মর্যাদা বা অবস্থান হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং তাতে আমাদের ঋণ নেয়ার খরা আরও বেড়ে যেতে পারে। অবশ্যই এই মুহূর্তেই আমাদের সেইসব নাগরিককে সাহায্য করতে হবে, যারা এই মহামারী পরিস্থিতির মধ্যে কষ্টেসৃষ্টে চলেছেন। তবে আরও বেশি পরিমাণে নগদ অর্থ বিলি করার বদলে আমরা কোরীয়রা, তাইওয়ানীরা, সিঙ্গাপুরীরা, চীনারা এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষ যেভাবে করছে সেভাবে হয়ত করতে পারি। আর তা হলো সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকেই শুধু নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া এবং উৎপাদন বাড়াতে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এমন অবকাঠামোয় আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা। পূর্ব এশীয়রা বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো বিষয়গুলো প্রদানকে ঘিরে তাদের সরকারের পরিধি বড় করার চাইতে বরং সরকারগুলোকে আরও করিৎকর্মা ও তৎপর করে তোলার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। এই মহামারীর অধ্যায়টা তারা যে পাড়ি দিতে পেরেছে এবং তার জন্য তেমন কোন বেগ যে পেতে হয়নি তার একটা কারণ হলো এটা। বাইডেন শীঘ্রই বড় ধরনের অবকাঠামোর প্যাকেজ হাতে নেয়ার পরিকল্পনা করছেন। সেটা তিনি পুরোপুরিই পেয়ে যাবেন। আমি শুধু আশা করব যে, আমরা যখন সবচেয়ে ফলপ্রসূ ছাড়াই- অবকাঠামোটা পেয়ে যাব, তখন যেন কংগ্রেস ও বাজারসমূহকে ঋণঘটিত অবসন্নতা পেয়ে না বসে। আরও অগ্রসর হয়ে প্রশ্ন করতে হয় অধিকতর জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রত্যেকের জন্য পুঁজিবাদ এবং ধনীদের জন্য কম ঝাঁকুনি দেয়া সমাজতন্ত্র হলে কেমন হয়। অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন এবং তারপর সেগুলোর ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু করার মধ্য দিয়েই কিন্তু অর্থনীতি বিকশিত হয়। শর্মা লিখেছেন, ‘উদ্যোক্তার ঝুঁকি ও সৃজনশীল ধ্বংস ছাড়া পুঁজিবাদ কাজ করে না। ধ্বংস হবে, চূর্ণবিচূর্ণ হবে আবার নতুন করে সৃষ্টি হবে এটাই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রাণ। সেটা না হলে সেই প্রাণই থেমে যাবে। নবীন অঙ্কুর বিনষ্ট হয় অঙ্কুরেই।’ [নিউইয়র্ক টইমসের অভিমত কলামে প্রকাশিত নিবন্ধনটির নাম ‘মেড ইন ইউএসএ-সোশ্যালিজম ফর দ্য রিচ, ক্যাপিটালিজম ফর দ্য রেস্ট]
×