ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সৈয়দ ফারুক হোসেন

রাজধানীতে বেপরোয়া এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রাজধানীতে বেপরোয়া এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং

রাজধানীর গণপরিবহনে প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। লোকাল বাস, সিএনজি অটোরিক্সা, টেক্সিক্যাবসহ গণপরিবহনের প্রতিটি সেক্টরেই প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা ধরনের ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে নগরবাসী। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের হাত ধরে সারাবিশ্বেই যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এ্যাপভিত্তিক ব্যবসায়, বাণিজ্য এবং রাইড শেয়ারিং তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তৃৃতির সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরে ইতোমধ্যে এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পাঠাও এবং উবার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু গণপরিবহনের বেপরোয়া চালকদের মতো এসব এ্যাপভিত্তিক নেটওয়ার্কেও কিছু বেপরোয়া, অদক্ষ ও অপরাধপ্রবণ বাইকার ও গাড়ি চালক ঢুকে পড়েছে। এদের কারণে পাঠাও এবং উবারের মতো গণপরিবহন নেটওয়ার্কিং এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া ও অদক্ষ বাইক চালনার শিকার হয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাঠাও চালক ও আরোহীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ও দুর্ঘটনা ঘটে। দেশের গণপরিবহন সেক্টরে একটি আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছে মানুষ। আশা করা হচ্ছিল পাঠাও ও উবারের মতো এ্যাপভিত্তিক সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে। দেখা যাচ্ছে দেশের গণপরিবহনের বেপরোয়া ও অদক্ষ চালকরাও এখন এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেক্টরে ঢুকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে উবার, পাঠাওসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে বাইক, গাড়ি ও চালক রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আরও সতকর্তা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে শুধু নির্দিষ্ট সেবা সংস্থার এ্যাপ বা সফ্টওয়ার নেটওয়ার্কের ওপর ছেড়ে দিলেই হবে না। রেজিস্ট্রিকৃত সেবা সংস্থার আনফিট গাড়ি, অপেশাদার ও অদক্ষ চালকদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগেরও প্রয়োজনীয় নজরদারি থাকতে হবে। বিশ্বের কোথাও গণপরিবহন ও টেক্সিক্যাব চালকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ যেন বিরল ব্যতিক্রম। ঢাকার ভয়াবহ যানজট আর সহজলভ্যতা- এই দুটো কারণে রাইড শেযারিং এ্যাপের মোটরসাইকেল আজকাল খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসেবে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। ২০১৭ সালে সারাদেশে তিন লাখ ২৫ হাজারের মতো নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। পরের বছর এর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের বেশি। এর একটি বিশাল সংখ্যা শুধু ঢাকাতেই। আবার একই সঙ্গে অভিযোগের তীরও মোটরসাইকেল চালকদের দিকেই বেশি। যারা একটু আয়েশি, গাড়ির মালিক নন অথচ গাড়িতে চড়ার স্বাদ পেতে চান, গাড়ি কেনার ঝামেলায় যেতে চান না, অথবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ঘুরতে যেতে চান, এমন অনেক ক্ষেত্রেই শুধু স্মার্টফোনে কয়েকটি ক্লিক দিলেই মিনিট কয়েক পরই দোরগোড়ায় এসে হাজির হচ্ছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। এই সুবিধার কারণেই এতটা জনপ্রিয় হচ্ছে রাইড শেয়ারিং এ্যাপের গাড়ি সেবাও। মোটরসাইকেলের সেবার মতো এতটা না হলেও তাদের নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। রাইড শেয়ারিং এ্যাপগুলোর কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের কাছে যে অভিযোগগুলো আসে তার মধ্যে অন্যতম হলো চালকের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি, পছন্দমতো জায়গায় যাত্রীকে তুলতে না চাওয়া অথবা ভাড়া নিয়ে বিবাদ। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগই সবচেয়ে বেশি। দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য অনেকেই এখন এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকে চলাচল করেন। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকে অনেক নারীকেও চলাচল করতে দেখা যায়। কিন্তু উবার-পাঠাওয়ের মোটরবাইক থেকে পড়ে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে, বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। ফলে উবার-পাঠাওয়ের মোটরবাইক যাত্রীদের জন্য কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ চালকের ঢাকার রাস্তাঘাট পর্যাপ্ত জানাশোনা নেই। বাইক চালনায় চালকদের দক্ষতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেক চালকই ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত গতি নিয়ে বেপরোয়া চলাচল করেন। যে কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। আবার অনেক চালক মানিকগঞ্জ, সাভার কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে ভাড়ায় মোটরবাইক চালান, যাদের ঢাকার রাস্তাঘাট তেমন জানাশোনাও নেই। এদের অনেকেরই গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নেই। কিছুসংখ্যক অদক্ষ ও অপরাধপ্রবণ চালকের কারণে এ খাত আস্থাহীনতার সঙ্কটে পড়লে এর সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নজরদারি প্রয়োজন। আর কোন পাঠাও চালকের বেপরোয়া বাইক চালনার শিকার হয়ে যেন কোন আরোহীর হতাহতের ঘটনা না ঘটে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলের বিশেষ সতকর্তা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট কোন নিয়ম-কানুন না থাকার কারণে ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকে যাতায়াত শুধু নারীদের জন্য নয়, সব যাত্রীর জন্যই অনিরাপদ। কেননা, চালকদের অনেকের প্রশিক্ষণ নেই। তা ছাড়া অনেকে আবার রাজধানীর সড়ক সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচিতও নয়। ফলে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। লাখ লাখ মোটরসাইকেলের কারণে একদিকে যেমন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, তেমনি সড়ক-ফুটপাথের যাত্রী ও পথচারীরা বেশিরভাগ সময়ই বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ছেন। সেবা ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, চালক এবং রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রী নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। বেশিরভাগ মোটরসাইকেল রাইডার নিজে হেলমেট পরলেও যাত্রীর জন্য হেলমেট রাখছেন না। অনেক চালক নামেমাত্র হেলমেট রাখলেও সেটা আর পরার যোগ্য থাকছে না। ঘটছে দুর্ঘটনা। মুঠোফোনে রাইড শেয়ারিং এ্যাপস অনেক নগরবাসীর জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। গত দুই-আড়াই বছর ধরে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে খুব সহজেই আসা-যাওয়া করা যাচ্ছে এ্যাপভিত্তিক ভাড়ায় চলা যানবাহনে। শুরু থেকে উবার-পাঠাওসহ এ্যাপভিত্তিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালার বাইরে থাকলেও চলতি বছর নীতিমালা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতির মধ্যে আনার দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ)। তবে এখনও পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি পাঠাও-উবারসহ রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো। যাত্রা শুরুর পর থেকে এ্যাপভিত্তিক এসব রাইড প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। তবে কোন নীতিমালা না থাকায় গ্রাহকরা এর কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। গত কয়েক বছরে প্রায় এক ডজনের বেশি এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানি গড়ে উঠেছে। স্যাম, মুভ, উবার, পাঠাও, সহজ.কম, চলো, বাহন, গাড়ি ভাড়া, ডাকো, ওভাই, আমার বাইক, শেয়ার মোটরসাইকেল, বিডিবাইক, ইজিয়ার ও রাইডার রাজধানীতে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার যাত্রী পরিবহন সেবা চালু করেছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সরকারী নীতিমালার আওতায় আসার জন্য মোট নয়টি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর কাছে আবেদন করেছে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এসব এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও এখনও পূর্ণ অনুমোদন পায়নি। তবে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে শীঘ্রই পর্যায়ক্রমে অনুমোদন দেয়া হবে। গত জানুয়ারি মাসে রাইড শেয়ারিং পরিবহন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নীতিমালার খসড়া অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই নীতিমালার ৮টি অনুচ্ছেদে ১১টি শর্তও দেয়া হয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে ১. কোম্পানিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে তালিকাভুক্তির সনদ নিতে হবে। ২. এ্যাপসের মালিককে টিআইএনধারী হতে হবে এবং নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। আর কোম্পানি হলে জয়েন্ট স্টক থেকে কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। ৩. নিজস্ব অফিস থাকতে হবে। ৪. ঢাকায় সেবা দেয়ার জন্য কমপক্ষে ১০০, চট্টগ্রামে ৫০টি এবং অন্য জেলা শহরে ২০টি গাড়ি থাকতে হবে। ৫. গাড়িগুলোর বিআরটিএ থেকে ট্যাক্স পরিশোধ ও রুট পারমিট আপডেট থাকতে হবে। ৬. মালিক ও চালকের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি থাকতে হবে। ৭. স্ট্যান্ডছাড়া যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। ৮. বিআরটিএর ওয়েবসাইটে এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, মালিক ও চালকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। ৯. তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনের সঙ্গে এক লাখ টাকাসহ অন্যান্য ফি জমা দিতে হবে। তালিকাভুক্তির মেয়াদ হবে তিন বছর। পরে এটি নবায়ন করতে হবে। নবায়ন ফি হবে ১০ হাজার টাকা। ১০. মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে অনলাইনে অভিযোগ করা যাবে। ১১. শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে তালিকাভুক্তির সনদ বাতিলসহ প্রচলিত আইনে মামলা করা যাবে। সরকারের বেঁধে দেয়া এসব শর্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মানছে না । ফলে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। এ বিষয়ে সরকারের আরও নজরদারি প্রয়োজন। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×