ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হারিয়ে যেতে বসেছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন "নকশি পিঠা"

আবু সালেহ মোঃ হামিদুল্লাহ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭:৫৮, ৮ জুন ২০২৫

হারিয়ে যেতে বসেছে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন

ছবিঃ জনকণ্ঠ

দেশের অঞ্চলভেদে খাবারের বৈচিত্র্যতায় অন্যতম একটি জেলার নাম কিশোরগঞ্জ। এখানকার বেশকিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে যা নিজ অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এ অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য খাবারের সাথে বেশ কয়েকটি পিঠার নাম যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে। যেমন: চ্যাপা পিঠা, কলাপিঠা ও নকশি পিঠা। নকশি পিঠা হচ্ছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠা। তবে নকশি পিঠাকে আঞ্চলিকভাবে পাক্কন পিঠা নামেই সবার কাছে পরিচিত।

 অন্যান্য পিঠার তুলনায় নকশি পিঠার সমাদর এখানে বেশি।‌ স্থানীয় মানুষের মাঝে প্রচলিত রীতি হলো এই পিঠা অনেকে মিলে বানাতে হয়। বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় এই পিঠা বানাতে। কিন্তু শত ঝক্কি ঝামেলায়ও কদর কমেনি এই পিঠার। পিঠা বানাতে প্রথমেই প্রয়োজন আতপ চালের গুড়া। তারপর হালকা গরম পানি দিয়ে কাই করে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হয় যেন কাই বেশি নরম বা শক্ত না হয়। কাই ঠিক না হলে পিঠা ফেটে যায়। 

তারপর বড় বড় করে রুটি বানিয়ে গোল ছাঁচে কাটা হয়। এরপরই শুরু হয় আসল কাজ। একেক জন একেক ভাবে তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের নকশা। নকশা তৈরিতে খেজুরের কাটা, সুঁই ব্যবহৃত হয়। ফুল, লতা পাতা, পালকি, নৌকা, পাখি - কী নেই নকশায়। তবে বেশিরভাগ লক্ষ্য করা যায় ইংরেজি অক্ষরের বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে পিঠা বানানোর প্রবণতা।

নকশাগুলোর থাকে ভিন্ন ভিন্ন নাম। কন্যামুখ, জামাইমুখ, জামাইমুচড়া, সতীমুচরা, শঙ্খলতা, কাজললতা, পদ্মদীঘি, সাগরদীঘি, চিরলপাতা, হিজলপাতা, বেঁট ফুল, আরো অনেক নাম দেয়া হয়।

নানা ধরনের নকশা করে পিঠা বানানোর পর ডোবা তেলে ভাজা হয়। কখনো আবার ভাজার পূর্বে পিঠাগুলো রোদে শুকানো হয়। তেলে ভাজার পর সাথে সাথেই গুড়ের রসে ভেজানো হয়। এভাবেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী নকশী পিঠা বা পাক্কন পিঠা। এই পিঠা গুলো বিশেষ করে ঈদ উপলক্ষে তৈরি করা হয়। ঈদের একমাস আগে থেকেই তারা এই পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কারণ এই পিঠা গুলো তৈরি করার পর তেলে ভেজে ভালোকরে রোদে শুকাতে হয়। রোদে শুকানো শেষ হলে পরবর্তীতে তা সংরক্ষণ করে রেখে বিভিন্ন উৎসব অথবা বাড়িতে বিশেষ কোনো অতিথি আসলে প্রথমে এই পিঠা গুলো পরিবেশ করা হয়। 
তবে পরিবেশনের পূর্বে সংরক্ষিত পিঠা গুলো পূণরায় ডোবা তেলে ভেজে চিনি অথবা গুড়ের  রসে ডুবিয়ে তারপর পরিবেশন করা হয়। 
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে আসছে এই পিঠার তৈরির দিক থেকেও। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সকল ক্ষেত্রেই। গ্রামের মানুষগুলোও যান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই কেউ আর পরিশ্রম করে এসব পিঠা বানানোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

বাজারের কেনা সেমাই, নুডুলস, ক্ষীর পায়েস ইত্যাদি খাবার দিয়েই বিভিন্ন উৎসবে অতিথি আপ্যায়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের মতে, কিশোরগঞ্জের এই হারিয়ে যাওয়া নকশি পিঠার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য নতুন প্রজন্মের ভূমিকা পালন করতে হবে এবং হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে তাদের‌ই পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিতে হবে।

সাব্বির

×