(গতকালের পর)
আমরাও তো অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারণের সঙ্গে বানানের সঙ্গতি রক্ষা করি না। অন্ত অ-কারকে বাদ দিয়েই আমরা বেশিরভাগ শব্দ উচ্চারণ করি। যেমন কাজ (কাজ্), চাঁদ (চাঁদ্), হাত (হাত্), বানান (বানান্)। এখানে আমরা কখনও অ বর্ণটিকে হস্ চিহ্ন দিয়ে লিখি না। তাই যা উচ্চারণ করব বানানে হুবহু তাই লিখতে হবে এমন নিয়ম চালু করলে অনাবশ্যকভাবে শব্দে নতুন নতুন বর্ণ যোগ করতে হবে। তাতে শব্দের চেহারা পাল্টে যাবে, লেখার সময় বাড়বে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করে শব্দ সৃষ্টি হয়। সুতরাং বানানের সঙ্গে প্রকৃতি ও প্রত্যয়েরও একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাকে ত্যাগ করা যায় না।
এ সম্পর্কে ড. হায়াৎ মামুদ লিখেছেন,
“বাংলা ভাষায় ‘বৌ’ বানান পাল্টে দিয়ে যখন ‘বউ’ মুদ্রিত হরফে হেথা-হোথা বেরুচ্ছে তখন অনাচার দেখে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন: ‘ছিঃ! ছিঃ! শেষ পর্যন্ত বৌ হল এমন। বউ, তো বউ-এর মাথায় ঘোমটা কই? আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি যতখানি পরিহাসের, বস্তুত ততখানি নয়। বক্তা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেই হয়তো বাংলা ভাষার লেখ্য রূপের গড়ন নিয়ে অমন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সত্য উক্তি করতে পেরেছিলেন। ভেতরের বাণীটি এই যে, অক্ষর বা বর্ণের পেছনে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপের আভাসও কাজ করে। হঠাৎ-কে ইচ্ছে হলেই কি আমরা ‘হঠাত’ লিখতে পারি? বৌ-এর যেমন ঘোমটা লাগে, তেমনি হাত পিছলে আচমকা পড়ে যাবার জন্যে ৎ দরকার যে। ....বানানে ছবিটাও জরুরি। উপরন্তু, বানানের জন্মপরিচয় ও ইতিহাস আছে। পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা নেই যা উচ্চারণ অনুযায়ী হুবহু লেখা হয়। লেখা যে হয় না তার কারণÑ বানানের মধ্যে তার বংশপরিচয় লুকিয়ে থাকে, বানানে অনাচার ঘটলে ঐ পরিচয়টি হারিয়ে যায়। মৃণাল নাথ, ‘সাম্প্রতিক বানান সংস্কার : একটি সমীক্ষা’, তুষারকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত ভাষাভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫।
শ্রীসত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
বাংলা ভাষা যখন তার নিজের স্বরূপ নিয়ে সাহিত্য রচিত হওয়া আরম্ভ করে তখন থেকেই সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রয়োগ হতে আরম্ভ করে এবং তখন থেকেই সেসব শব্দে সংস্কৃত বানানই অনুসৃত হয়ে আসছে। সে বানানই বিগত আট শ’ বা নয় শ’ বছর যাবৎ চলে আসছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সে সকল শব্দ বাংলা ভাষায় প্রয়োগ করতে হলে সে বানানই গ্রহণ করতে হবে। কারণ সে বানান ঐতিহ্যময়ী ও ঐতিহাসিক। তাতে শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয়ও ঠিক থাকবে। মৃণাল নাথ, ‘সাম্প্রতিক বানান সংস্কার : একটি সমীক্ষা’, তুষারকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত ভাষাভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫।
বর্তমানে যুক্তাক্ষর ভেঙ্গে লেখারও একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুক্তাক্ষর সৃষ্টি হয়েছে সম্ভবত লেখার সময় বাঁচাতে এবং অক্ষরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে। প্রাচীনকালে সবই লেখা হত হাতে। তাই দ্রুত লেখার জন্য তাঁরা সৌন্দর্যবর্ধক যুক্তাক্ষর সৃষ্টি করেছেন। এখনও আমরা যখন হাতে দ্রুত কোন কিছু লিখতে যাই তখন সময় বাঁচাতে অনেক বর্ণকে এমনভাবে লিখি যা আসল রূপ থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। তাই সবক্ষেত্রে যুক্তাক্ষর না ভাঙ্গাই শ্রেয়। এতে অক্ষরের সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হবে তেমনি লেখার সময়ও বাড়বে। ‘যুক্তাক্ষর’ শব্দটিকেই যদি আমরা ভেঙ্গে এবং উচ্চারণ অনুসারে লিখি তাহলে দাঁড়ায় ‘যুক্তাক্ষর’ (যুক্তাক্খর)। সূর্য= র্সূয, অধ্যক্ষ= ওদ্ধক্খ। এভাবে ভেঙ্গে লিখতে গেলে হস্ চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে। তাতে সময়ের যেমন অপচয় হবে তেমনি শব্দটির সৌন্দর্যও নষ্ট হবে। তাছাড়া লেখার সময় কোনক্রমে হস্ চিহ্নটি বাদ পড়ে গেলে শব্দটির উচ্চারণ কেমন হবে তা একবার ভেবে দেখা দরকার। র- বর্ণের সঙ্গে প্রাচীন লেখকেরা উ-কার এবং ঊ-কারের ( ু ূ ) যে ভিন্ন রূপ লিখেছেন তার কারণ হাতে লেখার সময় উক্ত ‘কার’ দুটি র-বর্ণের নি¤œস্থ ফোটার সঙ্গে মিলিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন র-কে ব মনে করা হবে। ‘স’এর সঙ্গে ‘থ’ যোগ করলে লিখিত রূপটি প্রায়ই ‘সয’ই মনে হয়। বহু যুক্ত অক্ষরের ক্ষেত্রেই এটি হয়ে থাকে। ছাপার অক্ষরে হয়তো তা হবে না।
আমরা বানান সংস্কারের বিরোধিতা করি না। যেখানে সংস্কার আবশ্যক সেখানে তা অবশ্যই করণীয়। যেমন আগে রেফ-এর পরে অনেকে দ্বিত্ব বর্ণ ব্যবহার করতেন। সেটা বাদ দেয়া যুক্তিসঙ্গত। সংস্কৃত বৈয়াকণেরাও সেটা বিকল্প হিসেবে রেখেছিলেন; তখনও দ্বিত্ব বর্ণ ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা ছিল না। বাংলা ভাষার বর্ণসমূহ বৈদিক-সংস্কৃত বা ব্রাহ্মী অক্ষরের বিবর্তিত রূপ। বৈদিকে ৯ এবং দীর্ঘ ৯্৯-এর ব্যবহার ছিল। কিন্তু সংস্কৃতে তা প্রায় বাদ দেয়া হয়েছে। বাংলা ভাষায় আমরা তা পুরোপুরিভাবে বাদ দিয়েছি। বাংলা ভাষার উচ্চারণের প্রয়োজনে বিদ্যাসাগর মহাশয় য়, ড়, ঢ় এবং ক্ষ বর্ণের ব্যবহার চালু করেছেন। সংস্কৃতে তস্ প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকে। সে অনুযায়ী বাংলা ভাষায়ও এক সময় প্রায়শঃ, করতঃ, অন্ততঃ প্রভৃতি শব্দে বিসর্গ দিয়ে লেখা হত। কিন্তু এখন তা বাদ দেয়া হয়েছে। ক্ষ এবং হ্ম বর্ণ দুটি দেখতে প্রায় একই রকম। কোন্ কোন্ বর্ণ নিয়ে অক্ষর দুটি সৃষ্ট তা অনেকে বুঝতে পারেন না। ক্ষ-কে ভেঙ্গে লিখলে তার উচ্চারণ সংস্কৃত বা হিন্দীর মতো হয়ে যাবে। যেমন পরীক্ষা। হ্ম অক্ষরটি হ+ম। হ্ম, গু, শু, ক্ত, হৃ, রু, রূ, ক্র, ক্ত, ঙ্গ প্রভৃতি ফন্ট যথাসম্ভব স্বচ্ছ করা যেতে পারে।
চলবে...
লেখক : প্রফেসর, সংস্কৃত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়