১৯৭১ সাল। স্মৃতিতে এখনও সজীব। মনে পড়ে, তখন সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি। আমার বাবা তখন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তদানীন্তন নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের একজন নির্বাচিত সদস্য। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ঢাকায় কি ঘটেছে তা তখনও আমরা সুস্পষ্টভাবে ধারণা করতে পারিনি। মনে আছে, এর আগে মার্চ মাসের সম্ভবত ২০-২১ তারিখে আব্বা ঢাকায় গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য। ঢাকা থেকে ফিরে এসে আব্বা জানালেন, দেশের পরিস্থিতি ভাল নয়, যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আব্বার ওই কথাগুলো তখন ততটা অনুধাবন করতে পারিনি।
২৭ মার্চ থেকেই নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের ছোট শহর আমাদের মোহনগঞ্জে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মনে আছে, তৎকালীন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা ও সমসাময়িক তরুণেরা থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রিয় দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে ট্রেনিং গ্রহণ শুরু করে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বভাবতই অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করে দিতে সম্মত ছিলেন না। এ অবস্থায় আমার বাবা অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে থানার অস্ত্রাগার থেকে কিছু অস্ত্র ছাত্রদের দিতে অনুরোধ করলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সম্মত হন। এর ধারাবাহিকতায় আমার বাবা তৎকালীন এমপিএ ডাঃ আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদের নির্দেশে প্রতিদিন সকাল ১০টায় থানা থেকে ছাত্রদের অস্ত্র দেয়া হতো, আবার বিকেলে ট্রেনিং শেষে সেগুলো থানায় জমা দেয়া হতো। সে সময় যে সব স্থানীয় ছাত্রনেতা ওই ট্রেনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বরকাশিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, হোটেল পট্টির সামছু, তাজুল ইসলাম, আমাদের স্কুলের হেড মাওলানা স্যারের দুই ছেলে আনোয়ার ও আতাহার। আমার স্মৃতিতে জেগে থাকা এসবই যেন ইতিহাসের একেকটি পাতা।
কয়েকদিন পরে জানতে পারি, পাকিস্তানী দখলদার সেনারা ময়মনসিংহে চলে এসেছে। তখন আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি হাটনাইয়ায় (ছয়াশি) চলে যাই। কিছু দিন এ গ্রাম ও গ্রাম করার পর আগস্ট মাসের সম্ভবত ১৪ তারিখে মাসহ আমরা চার ভাইবোন ভারতের মেঘালয়ের তুরা জেলার একটি গ্রাম মহেষখোলায় আশ্রয় নেই। আমার বাবা মে মাসের শেষভাগে ওই মহেষখোলায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি গড়ে ওঠা ‘ইয়ুথ ক্যাম্পে’ প্রথমে ‘রিক্রুটিং অফিসার’-এর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই ক্যাম্পের ‘ইনচার্জ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাসার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ নবেম্বরের একটি রেজ্যুলেশন চোখে পড়ে। দেখতে পাই, তদানীন্তন উত্তর-পূর্ব জোনের ১১টি থানার সম্পূর্ণ বা আংশিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে একটি ‘জোনাল কাউন্সিল ফর সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গঠিত হয়েছিল যেটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আমার বাবা ডাঃ আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ এমপিএ। এই জোনাল কাউন্সিলের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমার এমপিএ আঃ কাদির সাহেব। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ মহকুমার মোট ৮ জন জনপ্রতিনিধি [এমপিএ এবং এমএনএ] ছিলেন এই জোনাল কাউন্সিলের সদস্য। জামালপুরের তৎকালীন এমএনএ করিমুজ্জামান তালুকদারের সভাপতিত্বে এই জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত অনুসারে মুক্ত এলাকাসমূহের প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য কয়েকটি থানায় এই জোনাল কাউন্সিলের কমিটিও গঠিত হয়েছিল। এই তথ্যটি ছোট হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের আরেকটি পাতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য ও ঘটনার মতো আমাদের অঞ্চলে গঠিত এমন একটি জোনাল কাউন্সিলের কর্মকান্ড আড়ালেই রয়ে যায়। সে সময় গঠিত এই জোনাল কাউন্সিল মুক্তাঞ্চলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা ও তদারকির জন্য এ্যাডভোকেট দেওয়ান শাহজাহান ইয়ার চৌধুরীকে (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য) ল’ ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছিল। বিষয়টি এলাকাভিত্তিক হলেও তা মহান মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট এবং তা ইতিহাসের একটি অম্লান ঘটনা।
অবশেষে এলো ১৬ ডিসেম্বর। সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে চরম হরষে জাতি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। আমরা বিজয়ের আনন্দ বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আসি সম্ভবত ডিসেম্বরের ৩য় বা ৪র্থ সপ্তাহে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ছিলাম একজন কিশোর। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। এই না পারার কষ্টে এখনও বেদনার্ত হই। মুক্ত স্বাধীন প্রিয় মাতৃভূমিতে এগিয়ে যেতে থাকি। সময়ের আবর্তে পড়াশোনা শেষে একজন আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় মনোনিবেশ করি। আইন পেশায় প্রায় ২০-২১ বছর অতিক্রম করার পর বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। যখন যেভাবে যেখানেই থাকি না কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কোন বই বা কোন লেখা চোখে পড়লে চেষ্টা করতাম তা সংগ্রহ করতে এবং তা পাঠে নিবিষ্ট হতে। এসব লেখা যেন ইতিহাসের একেকটি অমলিন অধ্যায়। এখনও এই আগ্রহ ও মানসিকতার কোন ঘাটতি নেই।
২০১২ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হয়। এ ট্রাইব্যুনালে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারার আক্ষেপটা অনেকাংশেই লাঘব হয়েছেÑ অনুভব করি। এ দায়িত্ব পালন যেন ছিল যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই প্রিয় স্বদেশ তাদের ঋণ পরিশোধের একটি সুযোগ। সব সময় মনে হয়েছে যে, এই ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে তাদেরই বিচার করার সুযোগ পেয়েছি যারা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতার নামে সুসংগঠিতভাবে নিরস্ত্র লাখ লাখ বাঙালীদের হত্যা করেছিল, সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল লাখো মা-বোনের। তাদের কেউ ছিল রাজাকার, কেউ ছিল আলবদর, কেউবা ছিল শান্তি কমিটির নেতা ও সদস্য। তাদের চরম ও সজ্ঞান দোষাবহ কর্ম ও আচরণ এসব বর্বরতা সংঘটনে দৃশ্যমানভাবে সহায়ক ছিল। তবে বিচারকার্য চলাকালে প্রত্যেক অভিযুক্তই তাদের পক্ষে স্বাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক তুলে ধরার পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছেন।
২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। প্যানেলে অপর দুই বিচারক ছিলেন বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী যারা প্রকৃত অর্থেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে সম্পৃক্ত ছিল তাদেরই বিচার হয়েছে এই দুই ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনাল-২ এ একটি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন হবিগঞ্জের সৈয়দ মোঃ কায়সার। বিচারে তার সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। এখন যে প্রসঙ্গটির অবতারণা করতে যাচ্ছি তা তার অপরাধ এবং সেই অপরাধের বিচার সম্পর্কে কিছু বলার জন্য নয়। সৈয়দ মোঃ কায়সারকে প্রদত্ত সাজা ও রায়ের ন্যায্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের তালিকায় অপেক্ষমাণ। তবে এই মামলার বিচার কার্যক্রমে প্রতিফলিত একটি চা-বাগান ও সেখানকার ‘ম্যানেজারের বাংলো’ সম্পর্কে নিজের অনুভূতি ও ভাবনা ব্যক্ত করাটা অনিবার্য মনে করছি। সেই চা-বাগানের বাংলোটির নাম ‘তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ম্যানেজারস বাংলো।’ আমার এই লেখার বাকি অংশের অনেকটাই এটিকে নিয়ে আবর্তিত থাকবে।
গত ৩ মার্চ ২০১৭ তারিখে আমি সস্ত্রীক ও এক ভাগ্নিকে নিয়ে মৌলভীবাজার গিয়েছিলাম একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে। পথে মুঠোফোনে আমার ঘনিষ্ঠজন মাধবপুরের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং সুপ্রীমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক সিনিয়র এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী সাহেবের সঙ্গে কথা হয়। তাকে বলি, ‘আমি মাধবপুর হয়ে মৌলভীবাজারের দিকে যাচ্ছিÑ তেলিয়াপাড়া চা-বাগানটি মাধবপুর থেকে কতদূর?’ আমার কৌতূহল বুঝতে পেরে তিনি বললেনÑ ‘আপনি চাইলে ১০-১৫ মিনেটের মধ্যেই তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে পৌঁছাতে পারবেন।’ কিন্তু আমি তাকে বললামÑ ‘কাল ৪ মার্চ ঢাকায় ফেরার পথে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে যাব।’ মাহবুব বললেন, ‘কাল ফেরার পথে আপনার আসার সময়টি জানাবেন।’ এভাবেই পরদিন তেলিয়াপাড়া চা-বাগান পরিদর্শনে যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলো।
৪ মার্চ সকাল সাড়ে নয়টায় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে পৌঁছাই। বন্ধু মাহবুব আলী এমপিসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং পুলিশ সুপার আমাদের স্বাগত জানান। বাংলোটির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার। মুগ্ধ হলাম। এই বাংলোটি পরিদর্শনের একটি উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হলো ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিকদের প্রথম সভাটি এই চা-বাগানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখান থেকেই আমাদের বাঙালী সামরিক অফিসারদের সমন্বয়ে একটি বাহিনী গঠন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর মামলা নম্বর আইসিটি-বিডি কেস নং-০৪/২০১৩ এ কয়েকজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্য হতেও ঐতিহাসিক এই তথ্যটি বেরিয়ে আসে। মামলাটির একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী কাজী কবির উদ্দিন [সাক্ষী নং-১] তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, ‘...৩ এপ্রিল ১৯৭১ বিকেল ৩টার সময় তৎকালীন ক্যাপ্টেন খালেদ মোশারফ (দু’ একদিন পরেই মেজর পদবিপ্রাপ্ত) জীপযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাধবপুর সড়ক ও জনপথের ডাক বাংলোয় আসেন। তিনি আমাকে এবং মোহাম্মদ আলী পাঠানকে তার জীপে উঠিয়ে একটি ম্যাপ দেখতে দেখতে সিলেটের দিকে রওনা হন। তেলিয়াপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এসে তিনি বলেন আমাকে টি-গার্ডেনের ম্যানেজারের বাংলোতে নিয়ে যাও। তার নির্দেশনা মতে আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছি। তিনি আমাদের বললেন এখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আগামীকাল একটি মিটিং হবে, জায়গাটি শ্রমিকদের নিয়ে তোমরা পাহারায় রাখ। আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মিটিং কয়টায় হবে এবং কারা আসবে। তিনি আমাকে বলেছিলেন এটা তোমার জানার বিষয় নয়। তোমরা এলাকাটি পাহারায় রাখ।’
সাক্ষী কবির উদ্দিন [সাক্ষী নং-১] আরও বলেন যে, ‘পরদিন ৪ এপ্রিল সকাল ৭-৮টা থেকেই সেই বাংলোয় লোকজন আসা শুরু করে। সেখানে স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মাওলানা আসাাদ আলী সাহেব, মোস্তফা শহিদ সাহেব আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পাই খালেদ মোশারফ তৎকালীন মেজর জিয়া (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি), মেজর শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মঈন, ক্যাপ্টেন নাসিম, লে. হেলাল মোর্শেদ, ক্যাপ্টেন শাফায়েত জামিলসহ অনেক সামরিক- বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ সেখানে আসেন। তেলিয়াপাড়া গার্ডেনের বাংলোটি সিলেট হাইওয়ের পাশেই অবস্থিত। হাইওয়ে থেকে এই স্থানটি ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতরে ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এখানে সম্ভবত স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত হবে। কিন্তু আমরা জানতে পারলাম সেখানে সামরিক নেতৃবৃন্দ ৩টি ফোর্স গঠন করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ করার জন্য।
চলবে...
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান,
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২