ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিগুণ খরচে ধান কেটে লোকসানে উৎসব ম্লান বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত খেতের ধান কাটা নিয়ে বিপত্তি উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে হাওড়ের ধান কাটা সম্পন্ন সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক উদ্যোগের তাগিদ

দুশ্চিন্তায় কৃষক ॥ বোরো ধান কাটতে তীব্র শ্রমিক সঙ্কট

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২২ মে ২০২২

দুশ্চিন্তায় কৃষক ॥ বোরো ধান কাটতে তীব্র শ্রমিক সঙ্কট

কাওসার রহমান/সমুদ্র হক ॥ সারাদেশে এখন বোরো ধান কাটার উৎসব চলছে। ক্ষেত থেকে ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত কৃষক-কিষানিরা। এই ব্যস্ততায় নতুন মাত্রা এনেছে যন্ত্রের মাধ্যমে ধানকাটা। কিন্তু পর্যাপ্ত যন্ত্রের অভাব এবং বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে পানিতে শুয়ে পড়া ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষক। হন্যে হয়েও পাওয়া যাচ্ছে না ধান কাটার শ্রমিক। ফলে ধান কাটার উৎসব ম্লান করে দিচ্ছে তীব্র দিনমজুর সঙ্কট। ধান কাটার জন্য দিনমজুর তথা কৃষি শ্রমিক পাওয়াই এখন কৃষকদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক পাচ্ছে না। অনেক এলাকায় অর্ধেক ধান দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। আবার স্থানীয় শ্রমিক পাওয়া গেলেও মজুরি বেশ চড়া। ফলে চড়া মজুরিতে ধান কাটতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে। আগে প্রতি বিঘা ধান কাটা-মাড়াইয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হলেও বর্তমানে সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ লাগছে। অর্থাৎ দ্বিগুণ খরচ দিয়ে ধান কেটে লোকসানের মুখে পড়ছেন কৃষকরা। গত দুই বছর ধরে ধান কাটায় যে রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল, এ বছর তা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। ফলে শ্রমিক সঙ্কটে ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। দেশে বোরো মৌসুমের ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট প্রতি বছরই তীব্রতর হচ্ছে। আর সঙ্কটের কারণে বাড়ছে মজুরিও। গত পাঁচ বছরে ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের তথ্য অনুযায়ী, একদিনে ১১শ’ থেকে হাজার টাকার নিচে শ্রমিক মিলছে না। বেশি মজুরিতে এসব শ্রমিক নিয়ে পরে লোকসানে পড়ছে কৃষক। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টিতে জমিতে শুয়ে ও হেলে পড়া ধান ঘরে তোলা, কিংবা আগাম বন্যায় ডুবে যাওয়ায় ধান কাটা নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে কৃষক ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে বোরো ধান কাটার জন্য তাদের দিনমজুরদের সন্ধানেই ছুটতে হচ্ছে। কিন্তু দিনমজুর না পেয়ে দেশের প্রধান ফসল বোরো ধান কাটার মৌসুমেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঠের ধান কাটার জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত। চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদও ভাল হয়েছে। কিন্তু ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে শুরু হযেছে বৃষ্টিও। তাই পাকা ধান জমিতে নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় দিন পার করছেন তারা। তবে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যদিয়ে শেষ পর্যন্ত এবছর হাওড়ে শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। অন্যান্য বছর যে উৎসবের মধ্য দিয়ে হাওড়ে ধান কাটা হয়েছে, এ বছর সেই উৎসব ছিল না। ছিল আগাম বন্যায় ফসল হারানোর শঙ্কা। শেষ পর্যন্ত শঙ্কা এবং পাহাড়ী ঢলে বাঁধ ভেঙ্গে বেশ কিছু এলাকার ধান তলিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই কৃষক এ বছর হাওড়ে ধান কাটা সম্পন্ন করেছে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই পাকা ধান দ্রুততার সঙ্গে কাটার জন্য শুরু থেকেই কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়েছে। ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও রিপার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি অন্য জেলা থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে। এ বছর হাওড়ে ধান কাটার জন্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও রিপার ব্যবহৃত হয়েছে। যার মধ্যে ৩০০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর অন্য জেলা থেকে আনা হয়। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও রিপার দেয়ায় হাওড়ে দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে। শুধু সুনামগঞ্জ জেলাতেই ৫৭৭টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর ধান কাটায় ব্যবহার হয়েছে। এর ফলে বৈরী পরিবেশের মধ্যেও দ্রুততার সঙ্গে বোরো ধান কাটা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের ধান কাটা মেশিন দেয়ায় আমরা ঝুঁকির মধ্যেও হাওড়ের ধান কাটা সম্পন্ন করতে পেরেছি। তবে পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এ বছর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের হাওড়াঞ্চলের বেশ কিছু এলাকার জমির ধান নষ্ট হয়েছে। গত ১ এপ্রিল থেকে পাহাড়ী ঢল শুরু হয়। এ সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে খুব বেশি বৃষ্টি না হলেও ভারতের মেঘালয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এর ফলে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢলে নদনদী উপচে হাওড়ের বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, শুধু হাওড়ে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারণে সাত জেলায় ৯ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকদের দাবি, শুধু সুনামগঞ্জে ৩১টি হাওড়ের ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর (২০২১-২২) দেশের হাওড়ভুক্ত ৭টি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের হাওড়ে বোরো ধান আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে। আর হাওড়ের বাইরে উঁচু জমিতে (নন-হাওড়) আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে। মোট (হাওড় ও নন-হাওড় মিলে) আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৩১৮ হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে হাওড়সহ সারাদেশে বোরোর আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। যদিও চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে চারা রোপণের সময় আবহাওয়া অনকূলে ছিল। এপ্রিলের শেষ ভাগে ধানে শীষ গজিয়ে মাড়াই কাটাইয়ের সময় প্রকৃতি বিরূপ হলো। এপ্রিলের মধ্যভাগে বৈশাখ মাস শুরু। এবার বৈশাখী ঝড় ভিন্নভাবে আঘাত করেছে অশনি ঘূর্ণিঝড় হয়ে। কখনও টানা বৃষ্টি কখনও থেমে থেমে বৃষ্টিপাতে নদীর পানি বাড়েনি। তবে বৃষ্টির পানি আটকে রয়েছে উঠতি বোরো ফসলের জমিতে। আবার ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টিতে নুয়ে পড়েছে ধানের মাঠ। ফলে মাথায় হাত পড়েছে কৃষকের। এমনিতেই চারদিকে পাকা ধান কাটার উৎসব চলছে। এই সময়ে খেতমজুর পাওয়া কঠিন। নুয়ে পড়া ধান গাছ কাটা আরও কঠিন। কৃষক তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ধান কাটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। স্থানীয় বা গ্রামের মজুর শ্রেণীর সংখ্যা কমেছে। জীবন মান উন্নীত হওয়ায় আগে যারা দিনমজুর ছিল তাদের অনেকেই এখন ক্ষুদ্র ও মধ্যম কৃষক। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আবাদী ভূমি ও বড় গৃহস্থের বর্গা চাষী হওয়ায় তারাও জমিতে আবাদ করেছে। তারাও দিনমজুরের সন্ধানে বের হচ্ছেন। গ্রামে স্বল্পসংখ্যক যে দিনমজুর আছে (যাদের একটি অংশের বাস এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে) তারা বাড়তি মজুরি হাঁকিয়ে বসেছে। উপায় না দেখে দ্রুত ধান কাটতে বাড়তি অর্থেই মজুর নিতে হচ্ছে। কৃষি প্রধান বগুড়া অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকায় খেতমজুর সঙ্কটের তীব্রতা। বগুড়া অঞ্চলে সঙ্কটের অন্যতম একটি কারণ হলো, বগুড়া জেলা শহর ও ১২টি উপজেলা এখন উন্নত। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতায় প্রতিটি উপজেলার সঙ্গে শহর ও গ্রামীণ সড়কের লিংক তৈরি হয়েছে। আধুুনিকায়ন হয়েছে যানবাহন। গরুর গাড়ি মহিষ ও ঘোড়া গাড়ি এখন নেই। নদীর চরগ্রামে ঘোড়ায় চালিত যে গাড়ি চলে তা লোকজন ও পণ্য পরিবহনে। রিক্সা ও ঠেলাও যান্ত্রিক হয়েছে। এইসব যান ব্যাটারিতে চলে। এ ছাড়াও ব্যাটারি চালিত দুই ও চার আসনের এক ধরনের যন্ত্রযান (ইজি বাইক অটো ও টোটো নামে অধিক পরিচিত) আমদানি হয়ে এসেছে। চীনা প্রযুক্তির এইসব যান বর্তমানে দেশেও তৈরি হচ্ছে। দামও নাগালের মধ্যে। প্রতিটির দাম ৭ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ টাকার মধ্যে (মান ভেদে)। গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় একদার দিনমজুরের অনেকেই এইসব যান ভাড়ায় চালাচ্ছেন। কেউ কিনেছেন। দৈনিক আয় দিনমজুরির চেয়ে বেশি হওয়ায় এরা খেতে মজুরের কাজ থেকে বিরত থাকছে। ফলে বছর কয়েক হয় ধান কাটার মৌসুমে দিনমজুরের অভাব শুরু হয়ে বর্তমানে তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশের প্রতিটি স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। উত্তরাঞ্চলের ফসলের মাঠে যান্ত্রিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে অনেক আগে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে চাষ, ধান মাড়াইকাটাই পর্যন্ত সকল কাজ হয় যন্ত্রে। যদিও চাহিদা অনুযায়ী এইসব যন্ত্র এখনও নেই। তারপরও কৃষক তাদের গ্রামের ধনী কৃষক ও ধনী গৃহস্থের কাছে থেকে যন্ত্র ভাড়া নিয়ে আবাদ করে। ফলে উৎপাদন খরচ অনেকটা কমে যায়। তবে পরিচর্যায় কামলা কিষানের প্রয়োজন হয়। এই কামলা কিষানেরও এখন সঙ্কট। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষক আশা করেছিল এবারের ফলন ভাল হবে। গত আমন মৌসুমে আবাদ ভাল হওয়ায় অনেক কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টর ভাড়া নিয়ে ধান কেটে নিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে এই হারভেস্টর মাঠে নামানো যাচ্ছে না। কারন ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে যেভাবে উঠতি ধান গাছ পানিতে নুয়ে পড়ে তাতে হারভেস্টর মাঠে নামলে ওই ধানও পিষে নষ্ট হয়ে যাবে। কম্বাইন্ড হারভেস্টরের নিয়ম হলো কোন জমির এক প্রান্তে নেমে ধানগাছের গোড়া থেকে কেটে হারভেস্ট তুলে প্রপেলারে মাড়াই করে বস্তায় ভরে দেয়া। সাধারণ হারভেস্টর কৃষক ম্যানুয়ালি চালিয়ে ধানের গোড়া কেটে জমিতে ফেলে পরে আঁটি করে বাড়িতে নিয়ে যায়। আগে যে কাজ খেতমজুর কাঁচি দিয়ে কাটত সেই কাজ করে ম্যানুয়েল হারভেস্টর। বোরোর জলাবদ্ধতার জমিতে এই ম্যানুয়াল হারভেস্টরও নামানো যাচ্ছে না। কারণ পানির নিচের গোড়ায় এই হারভেস্টর পৌঁছবার আগেই ধান নষ্ট করে দেবে। তাই চারদিকে থেকে বিপাকে পড়া কৃষক এখন মজুরের খোঁজে মাঠে নেমেছেন। চড়া দামে খেতমজুর নিয়োগ করতে হচ্ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দির কৃষক রফিকুল বললেন, ২০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। শুরুতে আবহাওয়া ভাল ছিল। ধান বেড়ে উঠেছে। শেষের বেলায় হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব বরবাদ করে দিয়েছে। খেতমজুর পাওয়াই যাচ্ছে না। জমির ধান কাটতে দিন হাজিরা এক হাজার টাকা থেকে ১১শ’ টাকা দাবি করছে। তারসঙ্গে তিন বেলার খোড়াকি (খাওয়া) দিতে হবে। এভাবে এক বিঘা জমির ধান কাটতেই ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাগছে। বোরো ধানের উৎপাদন ভাল হলে প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২৮ মণ পর্যন্ত ফলে। এবার বেশিরভাগ ধান শুধু কাটার অভাবে মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। ফলে উৎপাদন অনেক কমে যাবে। তিনি ভেজা ধান কেটে নিয়ে কিছুটা বিক্রি করেছেন। ধান বেচে লাভ করতে পারেননি। প্রতিমণ ধান বেচতে হয়ছে ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা ধরে। পাইকাররা বলছেন শুকনো ধান হলে বেশি দাম দেয়া যেত। যারা ধান কেটে শুকিয়ে বেচতে পারবেন তারা ভাল দাম পাবেন। বগুড়ার শেরপুরের কৃষক তোজাম্মেল জানালেন, তিনি জমির মালিকের কাছে থেকে বর্গা নিয়ে আবাদ করেছিলেন। বর্গা বাবদ যে অর্থ দিয়েছেন এবং প্রতি বিঘায় আবাদে যে খরচ হয়েছে তা তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। সোনাতলার কৃষক বাসেত আলী বলেন, প্রতি বিঘায় জমিতে খরচ হয়েছে অন্তত দশ হাজার টাকা। ২২ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। মজুরের অভাবে ১৬ বিঘা জমির ধান কাটতে পারেননি। যে পরিমাণ জমির ধান কাটতে পেরেছেন তাতেও খরচ বেশি পড়েছে। প্রতি বিঘায় ধান কাটার চুক্তি করা হয় ১০ হাজার টাকা। বোরো আবাদে প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। ধান মিলেছে গড়ে ১২ মণ। এই অবস্থায় খরচ বাদ দিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আগে ধান মাড়াই কাটাইয়ের পর গোখাদ্যের খড় বিক্রি করা যেত। এবার পানিতে ডুবে থাকা ধান গাছের খড়ও মিলবে না। কৃষকদের ক্ষতি উভয় দিকেই। একই কথা বললেন দুপচাঁচিয়ার কৃষক আবুল কালাম। তিনি বললেন, বগুড়ার পশ্চিমাঞ্চলের ধান আবাদের পর খড় বেশি মেলে। গোখাদ্যের এই খড়ের টান পড়বে। ভেজা ধান গাছে খড় মিলবে না। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ পৌর সদরের কৃষি শ্রমিক বক্কার হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের ধানগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এখন প্রতিবিঘা জমিতে চার থেকে পাঁচজন শ্রমিক বেশি লাগবে। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে খরচ হতো তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। সেখানে এখন অতিরিক্ত খরচসহ প্রায় সাত হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা। কিছু এলাকায় অর্ধেক ধান জমিওয়ালার অর্ধেক শ্রমিকের- এমন প্রস্তাবেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার লুনা বলেন, চলতি বোরো মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীসহ সকল স্তরের কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে ধান কাটা নিয়ে কৃষকরা একটু সমস্যায় পড়েছেন। জয়পুরহাট সদর উপজেলার আদর্শপাড়ার রুহুল আমিনসহ একাধিক কৃষক জানান, সম্প্রতি কালবৈশাখীর প্রভাবে পাকা এবং আধাপাকা ধানের গাছ জমিতে শুয়ে পড়েছে। কিছু কিছু নিচু জমিতে এখনও পানি জমে আছে। তাই ধান কেটে নিতে হচ্ছে চড়া দামে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে প্রতি বিঘা ধান কাটা যেত ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এখন সেই ধান কাটতে হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এখন প্রতি বিঘা ধান কেটে নিতে হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায়। জয়পুরহাটের বদলগাছির পারিচা গ্রামের কৃষক শামসুল হক বলেন, চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছি। আমার পাকা ধান ঝরে পড়ছে। কাটার লোক নেই। একদল পেয়েছিলাম। পাঁচ হাজার টাকা বিঘা চায়। আবার থাকা-খাওয়া। তাহলে তো ধান বেচে লোকসান হবে। আরেক কৃষক সালাম বলেন, মেশিন দিয়ে (হারভেস্টর) ধান কাটার জন্য মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন তিনি সময় দিতেই পারেন না। বারবার অনুরোধ করার পরও ধান কাটতে আসেননি। নিজেই পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে কাটছি। কিন্তু এত ধান নিজে কাটা সম্ভব নয়। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ একর জমির ধান কাটতে হয়। এ বিশাল পরিমাণে জমির ধান কাটতে যত সংখ্যক শ্রমিক প্রয়োজন তার অনুপাতে ৪০ শতাংশ কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। সে চাহিদা পূরণে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ধান কাটার যন্ত্রের প্রয়োজন সেটার মাত্র পাঁচ শতাংশ রয়েছে দেশের কৃষকদের কাছে। আবার সেই যন্ত্র দিয়ে আবার পানিতে ডুবে যাওয়া বা শুয়ে পড়া ধান কাটা যায় না। অনেক স্থানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ধান কেটে দিচ্ছে ॥ দক্ষিণাঞ্চলের নড়াইলে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ধান কেটে দিচ্ছে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠের ১৬ মে সংখ্যায়। অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়াতে ব্যতিক্রমী ও মানবিক উদ্যোগ নিয়েছ গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। তারা ধান কেটে কৃষকের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন। এমন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ার মতো। উল্লেখ্য গত বছর অনেক স্থানে ছাত্রলীগের কর্মীরা অনেক কৃষকের ধান কেটে দিয়েছিল। এবার তা চোখে পড়েনি। কম্বাইন্ড হারভেস্টর দরকার ॥ শুকনো আবহাওয়া থাকলে বোরো ধান মাড়াই কাটাই দ্রুত শেষ করা যেত। কৃষি কর্মকর্তাগণ এমনটিই বলছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের বগুড়া অঞ্চলের চার জেলায় ১২০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর আছে। সরকারী ভর্তুকিতে আরও ৬১টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে টার্গেটের চেয়েও অধিক জমিতে আবাদ হয়েছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টরে মেকানিক্সসহ জনা তিনেক মানুষ হলেই চলে। যন্ত্রই কাটাই মাড়াই ঝাড়াইয়ের পর ধান বস্তায় ভরে খড় আলাদা করে দেয়। বগুড়া অঞ্চলে যে কম্বাইন্ড হারভেস্টর এসেছে তা ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের তৈরি। বড় কম্বাইন্ড হারভেস্টরের দাম ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। মাঝারির দাম ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা। বগুড়ার কৃষি বিভাগের মাধ্যমে সরকারী ভর্তুকির কম্বাইন্ড হারভেস্টর অনেকে কিনেছেন। সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৫ লাখ টাকা। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে প্রতি বিঘায় ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় জমির ধান কেটে মাড়াই করে বস্তায় ভরে রেডি করে দিতে পারেন। প্রতি ঘণ্টায় এক একর জমির ধান কাটাই মাড়াই বাছাই ঝাড়াই ও বস্তায় ভরানো যায়। হারভেস্টর ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান শামীম জানান, এবারের বৈরী আবহাওয়ায় কম্বাইন্ড হারভেস্টর মাঠে নামানো যায়নি। তবে কয়েকদিন টানা রোদ উঠলে এবং জমি থেকে পানি নেমে গেলে দ্রুত ধান কাটা যাবে। এই উদ্যোগ নিতে হবে কৃষি বিভাগকে। বোরোর ফলন কম হওয়ায় ॥ বিভিন্ন স্থান থেকে খবর মিলেছে প্রতিটি জায়গায় অশনির থাবা পড়েছে। গত শতকের শেষ দিকে কৃষি বিজ্ঞানীরা নানা জাতের ধান আবিষ্কার করায় ভর বছর ধানের আবাদ হচ্ছে। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সাবেক পরিচালক কৃষি বিজ্ঞানী এ কে এম জাকারিয়া জানান, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভর বছর ধান উৎপাদনের নানা জাত অবিষ্কার হওয়ায় খাদ্য চাহিদায় তেমন প্রভাব পড়েনি। বিশেষ করে বোরো আবাদটি খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়েছে। তবে এবারের বোরো আবাদ কার্যত বিরূপ প্রকৃতি ও তীব্র মজুর সঙ্কটে চাহিদায় কিছুটা প্রভাব ফেলবে। কৃষি যন্ত্র ও আবাদের টার্গেট ॥ কৃষির চারারোপণ থেকে শুরু করে ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত যত যন্ত্র দরকার তার ৩০ শতাংশ দেশে রয়েছে। বোরো মৌসুমে কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ধান কাটার জন্য অন্তত ২০ হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টর দরকার। বর্তমানে আছে সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার। চলতি বোরো মৌসুমে সারাদেশে বোরো আবাদের টার্গেট করা হয় ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমি। যা থেকে চাল আকারে উৎপাদন হওয়ার কথা ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার মেটন। ধানের এক তৃতীয়াংশ আবাদ হয় দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায়। বগুড়া ও নওগাঁ আবাদ উদ্বৃত্ত অঞ্চল হিসাবে অধিক পরিচিত। রাজশাহী নাটোর পাবনা রংপুর গাইবান্ধা নীলফামারী অঞ্চলের বোরো ও আমনসহ সব ধরনের ধানের আবাদ বেড়েছে। প্রতিটি এলাকায় যন্ত্রচালিত কৃষির ব্যাপ্তি বেড়েছে। এখন গরু দিয়ে হাল চাষ খুবই কম। গোয়াল ঘর নেই। চাষাবাদ এখন পাওয়ার টিলারে। পরিচর্যায় কিছু শ্রমিক দরকার। তবে তা সামলানো যায় কম শ্রমিকে। কিন্তু ধান কাটতে খেতমজুর লাগেই। এখনও ধান মাড়াইয়ের ম্যানুয়াল ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর সব স্থানে পৌঁছেনি।
×