
পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে আবারও আশার আলোয় জেগে উঠেছে রংপুরের ‘শতরঞ্জি শিল্প’। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই শতরঞ্জি শিল্প এখন রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ৩৬টি দেশে। বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা গেছে- হস্তজাত এ শিল্প থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। গ্রামীণ বাঙলার চিরায়ত ঐতিহ্য নক্সাখচিত শতরঞ্জিতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। নতুন আশায় জেগে ওঠা দেশের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি
শিল্পের সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন- এস এম মুকুল
স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশ কারুশিল্পের জন্য গর্ববোধ করে আসছে। গ্রামের শিল্পী ও কারিগররা তাদের চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনযাপন করেন। এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশজাত উৎপাদন দিয়ে কারুশিল্প সামগ্রী সৃষ্টি করেন। এ দেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা উপকরণ দিয়ে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যে বস্তু, শিল্প ও শিল্পকর্ম গড়ে তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প হলো বস্ত্র শিল্প। বাংলাদেশকে বস্ত্রায়ন শিল্পের জন্মভূমি বলা হয়ে থাকে। শতরঞ্জি শুধু রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশেরও ঐতিহ্য বহনকারী পণ্য। আশার খবর হচ্ছে রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের হস্তশিল্প শতরঞ্জি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ডলার আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজারো মানুষের। প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পটি। স্বপেশায় ফিরে আসছেন পুরনো এই শিল্পের কারিগররা। উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জেলা রংপুর। প্রাচীন নিদর্শনাদি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে সমৃদ্ধ এ জেলাটি খুবই উল্লেখযোগ্য। রাজধানী শহর ঢাকা থেকে রংপুরের দূরত্ব ৩৩৫ কি.মি.। রংপর জেলা শহর থেকে পশ্চিমে সেনানিবাসের পেছনে ঘাঘট নদীর কোলঘেঁষে বিশাল এক গ্রামের নাম নিসবেতগঞ্জ। এ গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার উল ও সুতার শতরঞ্জি বুনে আজ স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের বোনা শতরঞ্জি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তাদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে রংপুরের অন্য এলাকায়ও অনেকে শতরঞ্জি তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। চিরায়ত বাংলার নয়নাভিরাম নকশার শতরঞ্জির নান্দনিকতা এখন আধুনিক বাংলাদেশে এমনকি বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে।
শিল্পের বিকাশ যেভাবে
১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সা’দত মোহাম্মদ সায়েমের নির্দেশে প্রথম সরকারীভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারীভাবে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হয়। এর পর থেকে অবধি অবহেলিত শতরঞ্জি শিল্পটি সরকারের দৃষ্টিতে আসেনি। বলা যায় অবহেলার শিকার হয়ে বিলুপ্ত হতে যাওয়া শিল্পটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে বেসরকারী উদ্যোক্তারা। রংপুর শহরের কারুপণ্যের মালিক শফিকুল আলম সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরও বহুমুখী হয়ে উঠে। তবে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মধ্য দিয়ে খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপিয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির পরিচয় ঘটে।
শিল্প নিয়ে কিছু কথা
রংপুর জেলার তাঁতীরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করে যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি বা ডুরি মূলত এক প্রকার কার্পেট, এক সময়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হতো। বর্তমান আধুনিক সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। শতরঞ্জি ফার্সি ভাষার শব্দ শতরঞ্জ শব্দ থেকে এসেছে। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে এটাকে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়। ইংরেজীতে যাকে ঈড়ঁৎংবংঃৎরঢ়বধ ঈড়ৎস ঈধৎঢ়বঃ বলা হয়।
ঘরের শোভায় শতরঞ্জি
শতরঞ্জি আগে শুধু ঘরের মেঝেতে বিছানোর জন্যই তৈরি হতো। সময়ের বিবর্তনে একই বুননে শতরঞ্জির ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, কুশন কভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশও তৈরি হচ্ছে। শতরঞ্জিতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয় ঘটিয়ে ডিজাইন করা হয়। জানা গেছে, ৬ থেকে ৯টি রঙের ৪০-৫০টি ডিজাইনের শতরঞ্জি বাজারে পাওয়া যায়। পাশাপাশি ইচ্ছা অনুযায়ী নতুন করে বা নিজের পছন্দের নকশা অনুযায়ী ফল, ফুল, কার্টুনের পায়ের ছাপÑ এসব আকারের শতরঞ্জিও পাবেন। শতরঞ্জির দাম নির্ধারণ করা হয় স্কয়ার ফিট হিসেবে। প্রতি স্কয়ার ফিট ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। রংপুরে রয়েছে শতরঞ্জির প্রায় ৩০টি দোকান। শতরঞ্জি পাওয়া যাবে ঢাকার শুক্রাবাদে, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, রাজধানী সুপার মার্কেট, গুলশান-২, ডিসিসি মার্কেট, গুলশান-১ নম্বরে। ফ্যাশন হাউস আড়ং, যাত্রাতে পাওয়া যাবে সুতার তৈরি ও মখমলের শতরঞ্জি।
রফতানি বাজার
তথ্য উপাত্ত থেকে দেখ গেছে- ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রফতানি করে আয় হয় ২০ হাজার ডলার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আইকা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী আমদানি করে তা ইউরোপের চাহিদা পূরণ করেছে। চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ‘আইকা’ ছাড়াও বিবি রাসেল ও কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। জানা গেছে- প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্পসামগ্রী রফতানি হয়, তার ৫০ ভাগই শতরঞ্জি। রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ৩৬টি দেশে। বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাই উদ্যোগ
রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ জাপান ও ভারতে সুনাম অর্জন করায় চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী শতরঞ্জি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ, শিল্প এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুত সংযোগ না থাকা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তারা শতরঞ্জি কারখানা গড়ে তুলতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের মতে, সরকারী সহযোগিতা পাওয়া গেলে দেশের কাঁচামাল দিয়ে এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আয় এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবে শতরঞ্জি শিল্প।