ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাতির প্রতি কেন বৈরিতা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

হাতির প্রতি কেন বৈরিতা

পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে বন্যপ্রাণী ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিরাজ করছে। মানুষের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে সখ্য গড়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীর। তেমনি কারও খেলার সাথী, প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহদের বাহনের একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীক বন্য হাতি। বাংলার লোকজ সংস্কৃতিতেও হাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাতির প্রতিকৃতি ছাড়া বাঙালীর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাই হয় না। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে লোভী মানুষগুলো মেতে উঠেছে টাকার নেশায়। নির্বিচারে হত্যা করছে বন্যহাতি। একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান ঘনবসতি নির্মাণের ফলে বন্যপ্রাণীরা হয়ে পড়ছে নিরুপায়। বাংলাদেশে গত দু’সপ্তাহে আটটি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। সর্বশেষ, কক্সবাজারের ঈদগাহ উপজেলায় এক বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। কেন দ্বন্দ্ব বাড়ছে : ফসল তোলা, পাকা ধান ও ফলের মৌসুমে হাতিদের উৎপাত বেড়ে যায়। তাদের তাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে টর্চ লাইট সরবরাহ করা হলেও হাতি এখন আর লাইট, আগুন বা মশালে ভয় পায় না। এ অবস্থায় স্থানীয়রা নিজেদের জানমাল রক্ষায় এমন কঠিন অবস্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলে দাবি করছে শেরপুরের নালিতাবাড়ির বাসিন্দারা মূলত পাহাড়ী এলাকার গভীর বনগুলোই হচ্ছে হাতির বিচরণক্ষেত্র। পাহাড়ের বনগুলোর গভীরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, বন কেটে সাফ করে হাতির বিচরণক্ষেত্র দখল করে সবজি চাষ করছে স্থানীয়রা। শেরপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতির বিচরণক্ষেত্রগুলোতে এ দৃশ্য দেখা গেছে। আবার হাতিরা যেন সবজির খেত নষ্ট করতে না পারে সে জন্য তারা খেতের চারপাশে জিআই তারের বেড়া দিয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। তারগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে কারও পক্ষে এক হাত দূর থেকে দেখাও সম্ভব নয়। সেই বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়েই মারা গেেেছ পাঁচটি হাতি। বাকি দুটির মধ্যে একটি মাথায় গুলি লেগে প্রাণ হারিয়েছে, আর অন্য হাতিটির মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি। আর শেষেরটি অনুমান করা হচ্ছে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার সময় পা পিছলে মারা গেছে। নানা কারণে গত দুই বছরে প্রায় ৩৮টি হাতির মৃত্যু হয়েছে জানায় বন বিভাগ। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত ছয় বছরে হত্যার শিকার অন্তত ১৫টি হাতির মধ্যে ১১টিই মারা গেছে বৈদ্যুতিক শকে। ছয়টির মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। অন্যদিকে শেরপুর অঞ্চলে ২০১৪ সাল থেকে সাত বছরে যে ১৮টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে তার মধ্যে আটটিরই মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুতায়িত হয়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তিনটি। হাতির মৃত্যুর অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে অসুস্থতা, বয়সজনিত কারণ, খাদ্যে বিষক্রিয়া ও পিটিয়ে মৃত্যু। ভারতের বনসংলগ্ন জনপদে হামলায় আহত হয়ে এপারে এসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে থাকে। এমনটা চলতে থাকলে মহা-বিপন্ন এই প্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সমীক্ষায় হাতির জন্য ঝুঁকি হিসেবে বনভূমি দখল ছাড়াও বন ঘেঁষে ধানসহ ফসল চাষ বৃদ্ধি পাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পাহাড় ও বনে অবৈধ বসতি স্থাপন করার কারণে বন্যহাতির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। শেরপুর সহকারী বনরক্ষকের কার্যালয়ের হিসাব মতে, জেলার প্রায় ২০ হাজার একর বনের মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে দুই হাজার ৪০০ একর। প্রসঙ্গত, বেশিরভাগ হাতির মৃত্যু ঘটেছে ফসলের মৌসুমে, অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। দেশে গত ২৫ বছরে হত্যার শিকার হয়েছে ১৫০টির বেশি হাতি। কোথাও ভাল নেই হাতি : স্থলচর প্রাণীর মধ্যে গোটা পৃথিবীতেই বৃহত্তম আর অমিত শক্তির অধিকারী হাতি। কিন্তু কার্যত তারা বিশ্বের কোথাও ভাল নেই। বাংলাদেশের মতো কম বনভূমি আর জনবহুল দেশে হাতির অবস্থা এখন বিশেষ ঝুঁকির মুখে। আবাসস্থল ধ্বংস ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি একের পর এক হাতির মৃত্যু ঘটছে। এতে করে দেশে প্রাণীটির অস্তিত্ব নিয়েই বিশেষজ্ঞ মহল ও পরিবেশ সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের বনাঞ্চল থেকে এশীয় প্রজাতির হাতি বিলীন হওয়ারই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য এই প্রাণীটিকে বাংলাদেশে মহা-বিপন্ন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রজাতিটি ১৯৮৬ সাল থেকেই (আইইউসিএন)-এর লাল তালিকায় রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) হিসাবে, বাংলাদেশের এশীয় প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ বয়সী হাতির সংখ্যা ২৫০টির কম। তবে ভারত থেকে মাঝে মাঝে আসা হাতিসহ দেশে হাতির সংখ্যা মোটা দাগে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০-এর মতো হতে পারে। এর মধ্যে শেরপুরের বনাঞ্চলে বিচরণকারী হাতির সংখ্যা মাত্র ১২০ থেকে ১২৫টি। ২০০৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭টি। বর্তমান আইনে হাতি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি দুই থেকে ১২ বছরের কারাদ- এবং এক থেকে ১৫ লাখ টাকা অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে হাতির হামলায় কেউ মারা গেলে তিন লাখ টাকা, আহত হলে এক লাখ টাকা এবং ফসলের ক্ষতি হলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের বিধানও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের কোন প্রয়োগ নেই বাংলাদেশে। হাতি হত্যা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ : চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যহাতি হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে হাতি হত্যা বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ প্রতিবেদন আকারে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পরিবেশ মন্ত্রণালয় সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। গত ২১ নবেম্বর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যহাতি হত্যা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। একই সঙ্গে রিট আবেদনে হাতি হত্যা বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে রুল জারির আরজি জানানো হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, দেশে মোট ১২টি এলিফ্যান্ট করিডর রয়েছে। কিন্তু এসব এলাকা এলিফ্যান্ট করিডর হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। অথচ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে হাতি চলাচলের জন্য করিডর সংরক্ষণের কথা বলা আছে। করিডর সংরক্ষণ না করায় মানুষ সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। হাতি চলাচলের পথে বাধা পেয়ে ওইসব ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষ আর হাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। অন্যতম এ কারণেও হাতি মেরে ফেলা হচ্ছে। তাই উক্ত রিটে হাতি হত্যা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়। কি করতে হবে : হাতির অবাধে বিচরণের জায়গাগুলো দ্রুত কমে আসছে। বন এলাকায় মানুষের বসতি বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে হাতির চলাচলের অনেক করিডর বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত হাতির চলাচলের পথে বাধা এলে ঘটে মানুষের সঙ্গে সংঘাত। খাবারের ভা-ারে টান পড়ার কারণেও জনপদে হানা দিচ্ছে তারা। বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে চড়াও হচ্ছে মানুষের ওপর। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের এক সমীক্ষা মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতির চলাচলের ১১টি করিডর ছিল। এর বেশিরভাগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া বন কেটে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল, রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, রেললাইন নির্মাণ এবং সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জত এলাকায় সরকারী স্থাপনা গড়ে তোলার কারণে হাতির চলাচলের পথ কমে গেছে। হাতির জন্য আরেকটি বড় বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। রেলপথটি ২৭ কিলোমিটার হাতির তিনটি বিচরণক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে গেছে। মহা-বিপন্ন এই প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে দেশব্যাপী হাতির এই বিচরণক্ষেত্রগুলো দখলমুক্ত করার পাশাপাশি হাতির নিরাপত্তায় স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে মত বিশেষজ্ঞদের। হাতি রক্ষায় আমাদের বন বিভাগের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতিক বাংলাদেশে হাতিকে নির্বিচারে হত্যার দায় বন বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদফতর এড়াতে পারে না। সরকার হাতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ হাতি সংরক্ষণ এ্যাকশন প্ল্যান (বিইসিএপি)’ প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনায় মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত, চোরা শিকার বন্ধ করা ও হাতির আবাসস্থল সংরক্ষণ বিষয়ে গবেষণাসহ ছয়টি লক্ষ্য ছিল। গত তিন বছরে এটি বাস্তবায়নের দৃশ্যমান নজির দেখা যায়নি। শেরপুরে বন্যহাতির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য ২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যমান, কার্যকর উদ্যোগ না থাকলে শুধু হা-হুতাশ করে কিছু হবে না। পাহাড়ে চাষবাসের জন্য বন বিভাগের জমি ইজারা দেয়া বন্ধ করাসহ প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে বন বিভাগের ২৭টি ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ (ইআরটি) কাজ করছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় গ্রামবাসীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ টিম গঠন করা হয়েছে। লোকালয়ে চলে আসা হাতিকে বনে ফিরিয়ে দেয়া তাদের কাজ। হাতির খাবারের সংস্থানের জন্য বাঁশ, কলা, কাশফুলের বাগান, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া ও চাপালিজাতীয় গাছ লাগানো হচ্ছে। পাশাপাশি খাবারের সংস্থানের আরও স্থায়ী রূপ দেয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। হাতিকে বনে রাখার জন্য ‘সুফল’ প্রকল্পের আওতায় ঔষধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এতে বনে গাছের ঘনত্ব বাড়বে। সবুজ আন্দোলন নামে একটি সংগঠন হাতি সংরক্ষণে আট দফা প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবগুলো হলো- বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে লোকবল নিয়োগ করতে হবে এবং বনের মধ্যে যাতায়াতের জন্য যুগোপযোগী বাহনের ব্যবস্থা করতে হবে; বনের মধ্যে অবস্থিত সকল অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং নতুন স্থাপনা যাতে গড়ে তুলতে না পারে তার জন্য আইন বাস্তবায়ন করতে হবে; রাস্তা ও রেললাইন নির্মাণের সময় বন্যপ্রাণী পারাপারের জন্য বাইপাস চ্যানেল বা নিরাপদ করিডর নির্মাণ করতে হবে; বন্যপ্রাণী হত্যা করলে মৃত্যুদ-ের বিধান চালু করতে হবে; বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ‘কুইক ফুড সার্ভিস’ সিস্টেম চালু করতে হবে; সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং টেকনাফ-উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সরকারীভাবে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; সকল রকম সার্কাস, হাতি দিয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজি বা খেলাধুলা দেখানো বন্ধ করতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বন কর্মকর্তাদের সম্পত্তির হিসাব দুদকে তলব করতে হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। হাতি রক্ষায় এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা হলে হাতির প্রতি মানুষের বৈরিতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। ২৪.১১.২০২১ লেখক : সাংবাদিক
×