আর হত্যা ক্যু নয় ॥ দেশবাসীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই বাংলাদেশে আর কোনদিন যাতে ’৭৫-এর মতো হত্যা, ক্যু এবং ষড়যন্ত্র না হয়। ঘাতকের বুলেটে আর কোন শিশুকে যাতে এভাবে জীবন দিতে না হয় এবং দেশের অগ্রগতি যাতে থেমে না যায়। আমরা এ রকম চাই না বরং চাই বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হবে। প্রত্যেকটি শিশুর জীবন এই দেশে অর্থবহ এবং সুন্দর হবে। কেউ অকালে ঝরে যাবে না। সোমবার বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২১’-এর উদ্বোধনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের মানুষের কাছে একটাই আহ্বান জানাব, এই শিশুদের নিরাপত্তা দেয়া, ভালবাসা দেয়া, সুন্দরভাবে তাদের জীবন গড়ে তোলা, তাদের জীবন সার্থক এবং অর্থবহ করা- এই কর্তব্য পালনই যেন সকলের আদর্শ হয়। গণভবন থেকে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের যৌথ উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বক্তৃতা করেন। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের মহাসচিব এবং শিশু বক্তা আফসার জাফর সৃজিতা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ পরিবেশিত শেখ রাসেলের দুরন্ত শৈশব ভিত্তিক অডিও ভিজ্যুয়াল পরিবেশনা ‘শেখ রাসেল এক অনন্ত বেদনার কাব্য’ এবং ‘থিম সঙ্গ’ পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্পকলা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু-এ ৫টি ক্যাটাগরিতে প্রতিটি এক ভরি করে ১০টি ‘শেখ রাসেল স্বর্ণ পদক’, ১০টি ল্যাপটপ ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এ ছাড়া, শেখ রাসেল অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের ১০টি ল্যাপটপ এবং লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং ডেভেলমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি) আওতায় প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে হতে সর্বোচ্চ উপার্জনকারীদের মাঝে ৪ হাজারটি ল্যাপটপ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের উদ্যোগে সারাদেশে আয়োজিত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। একইসঙ্গে অনুষ্ঠানে সংযুক্ত শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং স্টেডিয়াম প্রান্তে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয় এবং ‘শেখ রাসেল শৈশবে ঝরে যাওয়া ফুল’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ প্রকাশিত ‘শেখ রাসেল দৃপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ^াস’ শীর্ষক বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের উদ্যোগে পরিবেশিত মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, শিশু রাসেলের জীবন স¤পর্কে শিশু-কিশোরদের কাছে তুলে ধরতে সরকারের পক্ষ থেকে এবার থেকে প্রতিবছর তার জন্মদিনকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথমবারের মতো পালিত ‘শেখ রাসেল দিবস ২০২১’ এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস’। এ দেশের শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার জন্যই শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শিশুদের মেধা ও মনন বিকাশে নিয়োজিত এই সংগঠনটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সকলকেও এ সময় ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগজড়িতকণ্ঠে প্রিয় ছোটভাই শেখ রাসেলসহ পরিবারের সব সদস্যের নির্মম হত্যাকা-ের কথা স্মরণ করে বলেন, আমাদের দেশের আর কোন শিশুর জীবনে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে। তাদের জীবন যাতে সুন্দর হয়। কারণ, একজন শিশুকে হত্যা করা মানেই লাখো কোটি শিশুর জীবনকে শঙ্কায় ফেলে দেয়া। ’৭৫ এ শিশু রাসেলসহ জাতির পিতার পুরো পরিবারের হত্যাকা-, এর পরবর্তীতে একের পর এক ১৯টি সামরিক ক্যু এবং ক্যু নিবৃত্ত করার নামে হাজার হাজার সামরিক সৈন্য-অফিসার হত্যাকা- এবং ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা, ২০০১ পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াতের সীমাহীন সন্ত্রাস এবং ২০১৩, ১৪ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাস এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শিশুসহ নিরীহ মানুষ হত্যার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা ফুল পূর্ণাঙ্গভাবে ফোটার আগেই অকালে ঝরে যাবে এটা কারও কাম্য নয়। তিনি বলেন, আমরা এ রকম চাই না বরং চাই বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হবে। প্রত্যেকটি শিশুর জীবন এই দেশে অর্থবহ এবং সুন্দর হবে। কেউ অকালে ঝরে যাবে না। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে দেশবাসীর কাছে দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের মানুষকে একটা উন্নত জীবন দেয়া এবং শিশুদের নিরাপত্তা প্রদানে তার সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালেই শিশু নিরাপত্তার জন্য আইন প্রণয়ন করে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য ঘাতকের হাতে তারই সন্তানদের মৃত্যুবরণ করতে হয়, হত্যাকা-ের শিকার হতে হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথমবারের মতো পালিত ‘শেখ রাসেল দিবস ২০২১’ এর প্রতিপাদ্য ‘শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস’- যথার্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ, আমাদের দেশের শিশুরা একটা আত্মবিশ^াস নিয়ে আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে গড়ে উঠুক, সেটাই আমরা চাই। তিনি বলেন, আমাদের শিশুদের ভেতরের যে সুপ্ত প্রতিভা এবং জ্ঞান রয়েছে তা বিকশিত হোক এবং আগামীর বাংলাদেশ যেন স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। তার সরকার একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে দেশে কোন অন্যায়-অবিচার থাকবে না। মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচবে। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিশুদের দোয়া ও আশীর্বাদ জানিয়ে তাদের মনোযোগ দিয়ে লেখা-পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্য সম্পদ চুরি হতে পারে বা হারাতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া এবং শিক্ষা এটা এমন একটা সম্পদ, যেটা কেউ কারও কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না। সরকারপ্রধান এ সময় শিশুদের প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত আমাদের উৎকর্ষ সাধন করে। আর এই প্রযুক্তি পরিবর্তনশীল। কাজেই আমাদের শিশুরা ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তি শিক্ষা নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- সেটাই আমার কামনা। সারাদেশে কম্পিউটারপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের জীবন এর মাধ্যমে উন্নত হবে এবং দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাবে মর্মেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর এখন তার সরকার ধীরে ধীরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন। ছোট ভাই শেখ রাসেলের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, রাসেল ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের নিয়ে প্যারেড করাত। সে বড় ভাই শেখ জামালের মতো সেনা অফিসার হতে চাইত। বেঁচে থাকলে আজকে হয়তো সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হতো শেখ রাসেল। ‘৭৫-এর হত্যাকা-ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সেদিন রাসেল মায়ের কাছে যাব বলে কান্না করছিল। পড়ে থাকা বাবা-মা, ভাইদের ডিঙ্গিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকেও হত্যা করা হলো। আমার একটাই প্রশ্ন এ শিশুটির কী অপরাধ ছিল? আমাদের পরিবারের কী অপরাধ ছিল? বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই কী অপরাধ ছিল? শিশু রাসেলের নামকরণের ইতিহাস তুলে ধরে বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাদের পরিবারে পাঠাভ্যাস ভাল ছিল। সবাই বই পড়ত, পড়ে শোনাত। তার মা বই কেনার জন্য হাত খরচও দিতেন। রাসেল কমিকস বই পড়তে ভাল বাসত। তার জন্য কমিক বই কিনে নিয়ে আসা হতো। আর বাবা নোবেল লরিয়েট বার্টান্ড রাসেলের ফিলোসোফি মাকে শোনাতেন। তার ফিলোসোফি ব্যাখ্যা করতেন। বঙ্গমাতাও সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সে থেকেই বার্টান্ড রাসেলের আদর্শে অনুপ্রারিণত হয়ে তাদের ছোট ছেলের নাম রাসেল (শেখ রাসেল) রাখা হয়।