ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবু আফজাল সালেহ

পাবলো নেরুদা ॥ কবি ও কূটনীতিবিদ

প্রকাশিত: ২১:২১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

পাবলো নেরুদা ॥ কবি ও কূটনীতিবিদ

পাবলো নেরুদা। পাঠক বা সাহিত্যিক সমাজে এমন কোন ব্যক্তি নেই যিনি এ নামের সঙ্গে পরিচিত নন। তিনি শক্তিমান কবি। ছিলেন রাজনীতিবিদও। চিলির প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রত্যাহার করে নেন। সিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই সব্যসাচী ব্যক্তিত্ব বলা যায় পাবলো নেরুদাকে। আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো (Neftalí Ricardo Reyes Basoalto)। তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী কবি। ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই দক্ষিণ আমেরিকার চিলির পারালে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজ বা ইউরোপের বাইরে এই চিলিয়ান কবির মতো প্রতিভাধর ও প্রভাববিস্তারকারী কবি বিরল। তিনি দক্ষ রাজনীতিবিদ হলেও সাহিত্য ও রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলেননি। জীবদ্দশায় বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার), সিংহল (শ্রীলঙ্কা), হংকং, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা, স্পেন, প্রভৃতি দেশে সরকারী কূটনৈতিক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সালে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বরেণ্য প্রেমের কবি সাহিত্যে মর্যাদাবান নোবেল পুরস্কার পান। তেরো বছর বয়সে নেরুদা লা মানানা দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। এই পত্রিকাতেই তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে তিনি নিজের নাম বদলে পাবলো নেরুদা নামে সাহিত্য পত্রিকা ‘সেলভা অস্ত্রাল’-এ লিখতে শুরু করেন। এর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৯৪৬ সালে, তিনি এই ছদ্মনামটিকেই প্রকৃত নাম হিসেবে আইনসিদ্ধ করে নেন। ১৯২৩ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে, প্রকাশক না পেয়ে নেরুদা নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে বের করেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘টুইলাইট’। বইটি তাকে ব্যাপক প্রশংসা ও পরিচিতি এনে দেয়। পরের বছর এক প্রকাশক আগ্রহী হয়ে প্রকাশ করে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘টুয়েন্টি লাভ পোয়ে¤স এন্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার’। এই বইটি ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। বলাবাহুল্য, এটিই এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপঠিত কবিতাগ্রন্থ। অনেকে এটাকেই তার মাস্টারপিস রচনা বলে অভিহিত করেন। পাবলো নেরুদা বিশ্বের হাতেগোনা শ্রেষ্ঠতম কয়েকজন কবির অন্যতম, যিনি জীবৎকালে তো বটেই, এখনও অব্দি বহুলপঠিত ও সমাদৃত। প্রেম, হতাশা, প্রকৃতি, রাজনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনাভিজ্ঞতা তার কবিতার মূল বিষয়। প্রকরণে সব সময়ই নিজস্ব শৈলির অনুবর্তী, এবং বার বার নিজেকেই অতিক্রম করেন তিনি। তার মূল পরিচয় কবি হলেও রাজনীতিক হিসেবেও সমান সমাদৃত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক আদর্শে ঘোর মার্কসবাদী। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। সিনেটর নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন, যদিও জোট-রাজনীতির কবলে পড়ে তাকে শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। তাকে ‘প্রেম ও রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাবলো নেরুদা জীবৎকালেই কবি হিসেবে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন। তার রাজনৈতিক দর্শন তাকে সমাজতান্ত্রিক ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। নেরুদা পুরোপুরি সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন, কিন্তু সাহিত্যের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কখনও আপোস করেননি। তাঁর কবিতা উঁচু মানের এবং নিজস্ব শৈলীতে সৃষ্টি ও নির্মিত। নেরুদার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন প্রকাশ শৈলী ও ধারার সমাবেশ ঘটেছে। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন কামোদ্দীপনামূলক কবিতা, তেমনই রচনা করেছেন পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইস্তাহারও। প্রেম ও দুঃখ-হতাশার বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে ‘টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস এন্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার (১৯২৪)’ এবং ‘দ্য ক্যাপটেইন ভার্সেস (১৯৫২)’। এ দুটি কাব্যে দুঃখ ও হতাশার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতি নেরুদার গভীর আগ্রহই প্রকাশ পেয়েছে। চরম আনন্দের সময়ও নেরুদা তাঁর কবিতায় নিরানন্দের চিত্রকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। একাকীত্ব ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা থেকে রচিত-যেমন ‘রেসিডেন্স অন আর্থ (১৯৩৫)’- কিছু কবিতা এপিকধর্মী। ‘জেনারেল স্টাডি (১৯৫০)’ এই ধারার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া তিনি বাস্তব জীবনের সাধারণ বস্তু নিয়ে কবিতা লিখেছেন, যেমন ‘এলিমেন্টারি ওডস (১৯৫৪)’। আসলে প্রেম, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি এবং রাজনীতি তার কবিতার মূল বিষয় হয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন উপলক্ষে। সাহিত্য সমালোচকরা বলেন, বিষয়গত ঐক্য থাকলেও তার প্রতিটি গ্রন্থ, এমনকি প্রতিটি কবিতাই প্রকরণগতভাবে একক ও অনন্য সাধারণ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছেন, নেরুদা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি। তাকে প্রেম ও রাজনীতির কবি বলা হয়। নেরুদার প্রকাশিত ৬৫টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি বইয়ের বাংলা নাম হলো- গোধূলিলগ্ন, ক্ষুদ্র মানুষের ঝুঁকি, মর্ত্যরে অধিবাসী ১ ও ২, তৃতীয় অধিবাসী, হে স্পেন আমার হৃদয়, স্তালিনগ্রাদের সঙ্গীত, মাচ্চু-পিচ্চুর শিখরে, মুক্তিযোদ্ধা, এই প্রান্তরের নাম হুয়ান, হে মহাসমুদ্র, আমি আছি, প্রজ্বলিত তরবারি, অনুর্বর ভূখন্ড, সমুদ্রের ঘণ্টাধ্বনি ইত্যাদি। এছাড়া তার আত্মজীবনী ‘অনুস্মৃতি’ একটি অসাধারণ বই। পাবলো নেরুদার সেরা বই ‘১০০টি প্রেমের সনেট (১৯৫৯)’’। কবিতাগুলো লেখা হয় তাঁর বাড়ি ইসলানেগ্রায়। আপরিসর সমুদ্র-সৈকতের ফেনাময় নীল আর সাদা বালির পটভূমিতে ইত্যাদি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন উপমা আর উপাদানের মাধ্যমে। তাঁর ভালবাসার মানুষ তাঁর স্ত্রী, মাতিলেদ উরুশিয়াকে নিয়ে তাঁর এই অপরূপ কাব্য-নিবেদন। ১৯৬০ সালে প্রকাশ হয় প্রথম স্প্যানিশ সংস্করণ, তার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। কবিতাগুলোর স্প্যানিশ আদল সনেটের হুবহু অনুকরণ নয়। নেরুদার কবিতা বরাবরই পার্থিব, মাটিমাখা, তা শুনে, দেখে, শুঁকে, আস্বাদ করে নিতে হয়। স্বাভাবিক শব্দ-বন্ধে তিনি হাজির করেন অসাধারণ উপমা। যৌন-গন্ধমাখা পদাবলী, প্রাকৃতিক, পার্থিব উপাদান, জাদুবাস্তবতা আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আবদ্ধ করে ধ্রুপদী আকার দিয়েছে। নেরুদাকে একবার একজন বলেছিলেন-আপনার লেখাতো আপনার ব্যক্তি জীবনেরই অভিক্ষেপ। উত্তরে নেরুদা গর্বভরে বলেছিলেন-এমনই তো- ‘এখানেই একজন শিল্পী, জীবন শিল্পী। শুধু কল্পনা আর অভিজ্ঞতাহীন অবাস্তবতা নিয়ে তো সাহিত্য হতে পারে না।’ নেরুদার রাজনীতি ও দেশপ্রেম সম্পর্কিত কবিতার তীক্ষতা ও অনুভূতির গভীরতা তার প্রেমের কবিতায়ও রয়েছে। এখানে রয়েছে তাঁর উষ্ণ রক্ত স্রোতের প্রবাহমানতা, প্রবল আবেগ এবং হৃদ্যিক গভীরতা। মন্দাক্রান্তা সেনের ভাষান্তর কবিতাংশ এখানে উপস্থাপন করছি-‘মুক্ত কারও আমার দুহাত/আর এ হৃদয়, ওগো, মুক্ত করো আমার বন্ধন।/আমার এ আঙুলগুলো ইচ্ছেমতো ভ্রমণ করুক/তোমার তনুর পথে পথে।/উন্মাদনা-শোণিত, আগুন চুম্বনেরা-/...যখন আমার এই অর্ধদগ্ধ ঝলসানো জীবন/পাখা মেলে উড়ে যায় তোমারই তনুর দিকে,/নক্ষত্রখচিত সেই তনু, যেন রাত।/মুক্ত করো আমার দুহাত,/আমার হৃদয়, ওগো, মুক্ত করো আমার বন্ধন।/শুধু তোমাকেই চাই, শুধু তোমাকেই ভিক্ষা করি।’ (সংক্ষেপিত)। নেরুদার বিশটি প্রেমের কবিতা কমপক্ষে পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে- আর এর আবেদন শুধু চিলি, স্পেন কিংবা লাতিন আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা জীবনের বিশেষ মুহূর্তে এর কবিতা রক্তের স্পন্দনে উচ্চারণ করেছে। অনেকে হাতে লিখে একান্ত প্রিয়জনকে উপহার দিয়েছে এমন কবিতা। এখানে আমি উপস্থাপন করছি তার ‘এ রাতে আমি রচনা করতে পারি’ কবিতাটির অংশবিশেষ- ‘আমার হৃদয়-উৎসারিত বিষণ্ণ পঙ্ক্তিমালাগুলো/আজ রাতেই আমি কলাবন্ধনে নন্দিত করতে পারি।/এবং মনে করা যাক-এই নাক্ষত্রিক রূপালি রাত/ভালবাসার রাত,/তাই ছন্দিত হয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওই দূর নীলাকাশ।/রাতের মাতাল হাওয়া উদাস গগনে উতাল হয়ে/নন্দিত তানে থেকে থেকে গান গেয়ে যায়।/আর দীঘল টানা চোখ/তেমনি থাকবে!/তার চলে যাওয়াতেই আমার রক্তক্ষরিত হৃদয় হতে সৃষ্টি হলো কবিতা।’-(সংক্ষেপিত)। পরাবাস্তবতা কবিতা লেখাতেও কবি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে রচিত ক্যান্টো জেনারেল এর ‘কিছু প্রাণী’ কবিতার অনুবাদ এ রকম- ‘চিতা স্পর্শ করে পাতা/তার গরহাজিরার দীপ্তি দিয়ে,/ডালপালার মধ্য দিয়ে/দৌড়ে যায় বেড়াল,/এক ডুবন্ত আগুন;/তার ভেতরে এ্যালকোহলের মতো/জ্বলে ওঠে অরণ্যের চোখ।’ ১৯৭৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জীবনের শেষ কবিতাটি রচনা করেন নেরুদা। স্পেনীয় ভাষায় কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘লাস সাত্রাপিয়াস’-‘নিক্সন, ফ্রেই আর পিনোচে-/আজ পর্যন্ত, ১৯৭৩ সালের/এই তিক্ত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত,/সঙ্গে বোর্জেবেরি, গাররাস্তাজু ও বানজের/অতিশয় লোভী হায়েনারা/আমাদের ইতিহাসের, তীক্ষ দন্ত জানোয়াররা ফালাফালা করছে/রক্ত আর বিস্তর আগুনে অধিকৃত পতাকা,/সম্পদের ওপর হামলে পড়া/নারকী লুণ্ঠনকারী,/ক্ষমতাবান প্রাদেশিক শাসক বিক্রীত হাজারবা/এবং বিক্রেতারা, নিউইয়র্কের/নেকড়েদের দ্বারা উত্তেজিত।/যন্ত্রপাতি ক্ষুধার্ত ডলারের জন্য’-(সংক্ষেপিত)। মৃত্যুর পরেও কবি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এতটুকুও হ্রাস পায়নি। একদিকে তার চমৎকার প্রেমের কবিতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সমাজবাস্তবতা-বিষয়ক কবিতা তাকে সকল পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সালে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে পরলোকগমণ করেন কবি ও ঝানু এ কূটনীতিবিদ।
×