ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মানহানির অপচেষ্টা

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ৪ আগস্ট ২০২১

বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মানহানির অপচেষ্টা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ৪ মামলায় মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পৃথক আদেশে তার এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে তার অন্যতম দুই সহযোগী হাজেরা খাতুন ও সানাউল হককে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার হেলেনার এক ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অপরদিকে পল্লবী থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, প্রথমে মিরপুর থানার প্রতারণা মামলা এবং পল্লবী থানার টেলিযোগাযোগ আইনের মামলায় হেলেনার ৪ দিন করে মোট ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহীনুর রহমান। পরে বিকেলে গুলশান থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ৩ দিন করে ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি। সব মিলিয়ে ৪ মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলো। এদিকে মঙ্গলবার ভোরে হেলেনা জাহাঙ্গীরের প্রধান সহযোগী হাজেরা খাতুন ও সানাউল হক ধরা পড়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মান হানি করার অপচেষ্টার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব। হেলেনার আরও চার সহযোগীকে ধরার অভিযান অব্যাহত আছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর সঙ্গে জয়যাত্রা টিভির সঙ্গে সম্পর্ক প্রতারণার অংশ কিনা তা খতিয়ে দেখছে র‌্যাব। এ বিষয়ে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা জানান। সম্মেলনে এক সাংবাদিক জানতে চান, জয়যাত্রা টিভির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে কিনা। এ প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা দেখেছি, হেলেনা জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি ব্যবহার করতেন। এসব ছবি তিনি নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এবং বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণার জন্য ব্যবহার করতেন। আপনারা যা বলেছেন, তা এক ধরনের প্রতারণার অংশ কিনা তা গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন সংস্থা খতিয়ে দেখছে। আইপি টিভির নামে জয়যাত্রা স্যাটেলাইট টিভি পরিচালনা করে আসছিল। স্যাটেলাইট টিভি সম্প্রচারের সব যন্ত্রপাতি সেখানে ছিল। হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টেলিভিশনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিয়ে আসতেন। বিশেষ করে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরই হাজির করতেন। বিতর্কিত হেলেনা জাহাঙ্গীরের জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশনে প্রতিনিধি হতে চাইলেই গুনতে হতো টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে ১০ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে হতো চাকরিপ্রত্যাশীদের। টাকা ছাড়া জয়যাত্রায় কোন নিয়োগ দিতেন না হেলেনা। এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মাসিক হারে চাঁদা নিতেন হেলেনা। সেই চাঁদার পরিমাণ দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। র‌্যাব পরিচালক খন্দকার আল মঈন সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তার অন্যতম দুই সহযোগী হাজেরা খাতুন (৪০) ও সানাউল্লাহ নূরীকে (৪৭) ধরা হয়। হাজেরা খাতুন জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ডিজিএম ও জয়যাত্রা টিভির জিএম (এ্যাডমিন) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আর সানাউল্লাহ নূরী জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীরের এসব অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য জানতে পারে র‌্যাব। তিনি বলেন, আটক হাজেরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ২০১৮ সাল থেকে হংকং থেকে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ করে জয়যাত্রা টিভি চালু করেন। এজন্য হংকংককে প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। অথচ হংকং থেকে বরাদ্দ ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশে চ্যানেল সম্প্রচারের কোন বৈধ অনুমোদন নেই। এরপর জয়যাত্রা টিভির সম্প্রচারের জন্য প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের ক্যাবল ব্যবসায়ীদের কাছে রিসিভার সরবরাহ করা হয়। প্রতিনিধিরা ক্যাবল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সম্প্রচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে চাকরিচ্যুতিসহ অন্য প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে তাদের হেনস্তা করা হতো। দেশের প্রায় ৫০টি জেলায় জয়যাত্রা টিভি সম্প্রচারিত হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেলা প্রতিনিধি নিয়োগে ৩০-৫০ হাজার টাকা, উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগে ১০-২০ হাজার টাকা এককালীন দিতে হয়। এছাড়া প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে দুই-পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়। জয়যাত্রা টিভি প্রায় ৩৪টি দেশে সম্প্রচারিত হয়, যেখানে দেশের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতিনিধি নিয়োগে এক-পাঁচ লাখ টাকা নেয়া হতো। এছাড়া তাদের কাছ থেকে মাসিক ২০-৫০ হাজার টাকা নেয়া হতো। জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের বিষয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ডোনার, জেনারেল মেম্বার, লাইফ টাইম মেম্বার ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এই সংগঠনের প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছে। যাদের কাছ থেকে সদস্য পদ বাবদ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার সামান্যই মানবিক কাজে ব্যবহার করে জয়যাত্রা টিভি। এই অর্থ দিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো হতো। অবশিষ্ট অর্থ সন্তানদের নামে সঞ্চয় করেন হেলেনা। আটক সানাউল্লাহ নূরী জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নির্দেশনায় প্রতিনিধিদের সমন্বয় করতেন। প্রতিনিধিদের কেউ মাসিক টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বা গড়িমসি করলে তিনি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতেন। গাজীপুর এলাকায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। গাজীপুরে গার্মেন্টস সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে তার একটি অংশও জয়যাত্রা টিভিতে দিতেন তিনি। এছাড়া তিনি গাজীপুর ও বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদনহীন জয়যাত্রা টিভির সম্প্রচার নিশ্চিত করতেন। প্রতি মাসে চ্যানেল পরিচালনার টাকা হংকংয়ে পাঠানোর ভাউচার পেয়েছি। এছাড়া হেলেনার জমি-ফ্ল্যাট সংক্রান্ত তার তথ্য ও হাজেরার দেয়া তথ্যে গড়মিল পাওয়া গেছে। অর্থের বিষয়গুলো সিআইডি তদন্ত করবে এবং দুদককে অবহিত করা হবে। এদিকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের ভাই দুলাল শরীফকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পারভেজ ইসলাম বলেন, একটি মামলার তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জয়যাত্রা টিভির কার্যালয় থেকে তাকে হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
×