ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেনাপোল বন্দর থেকে লাখ লাখ টাকার পণ্য চুরি

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ৩ মে ২০২১

বেনাপোল বন্দর থেকে লাখ লাখ টাকার পণ্য চুরি

স্টাফ রিপোর্টার, বেনাপোল ॥ বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে আবারো পন্য চুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। বহিরাগত একটি শক্তিশালী চোর চক্রো রাতের আধারে বন্দরের বিভিন্ন শেড বা গুদাম থেকে লাখ লাখ টাকার পণ্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। চুরির ঘটনা নিয়ে বন্দর কাস্টমসও ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কাস্টমস ও ব্যবসায়ীরা বলছে পণ্য চুরির সাথে খোদ বন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত রয়েছে। এদের পিছনে আবার বন্দরের দুই উর্দ্ধোতন কর্মকর্তা নেপর্থ্যে কলকাঠি নাড়ছে। যে কারণে বন্দরের সেড বা গুদাম থেকে পণ্য চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। পণ্য চুরি বন্ধে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রির জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এখানকার বিভিন্ন মহল। জানা গেছে, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশের সিংহভাগ পণ্য আমদানী হয়ে থাকে। বলা যায় বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার পণ্য বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশের শিল্প কলকারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশের অধিকাংশ এ বন্দরের মাধ্যমে আমদানী হয়ে থাকে। সরকার প্রতি বছর আমদানীর খাত থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকেন। বন্দরের নানা অবকাঠামোগত সমস্য পণ্য চুরি,রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হারিয়ে ফেলছে। দীর্ঘ দিনর ধরে বন্দর থেকে পণ্য চুরি দেদারচ্ছে চলে আসলেও বর্তমান সময়ে তা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দর সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় আশ্রীত একটি সংঘবদ্ধ শক্তিশালী চোর চক্র রাতের আধারে বন্দরের গুদাম থেকে লাখ লাখ টাকার পণ্য চুরি করছে। প্রতিনিয়ত বন্দর থেকে আমদানিকৃত মালামাল চুরির ঘটনা নিয়ে বর্তমানে কাস্টমস-বন্দরও ব্যবসায়ীদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। বিশেষ করে কাস্টমসের নিলামকতৃ পণ্য চুরি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সরকারকে মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছেন, অতি সম্প্রতি বন্দরের ১নং শেড থেকে ১হাজার ১শ’ ২ টন উন্নতমানের শার্টিং ও প্যান্টিং চুরি করা হয়েছে। যার আমদানিকারক এইচবি ইন্টারন্যাশনাল নামী একটি প্রতিষ্ঠান। যার বেনাপোল, কাস্টমস মেনিফেস্ট নং-৩৬৩৪০/১। পণ্যটি মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বেশ আগেই আটক করেছিল। পরে চালানটি নিলামে বিক্রি করা হয় ৬১ লাখ টাকায়। কিন্তু নিলামকারী প্রতিষ্ঠান নোভা এন্টারপ্রাইজ পণ্যচালানটি ডেলিভারি নিতে গিয়ে ১হাজার ১শ’ ২ কেজি চুরি যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন। নিলামকারী তাৎক্ষনিক বন্দরের উপপরিচালক মামুন তরফদারকে জানালে তিনি নিলামক্রেতা মোহাম্মদ আলী খানকে হুমকি দিয়ে বন্দর থেকে বের করে দেন বলে অভিযোগ করেন। অপার দিকে খুলনার আমদানিকারক সান ওয়ার্ল্ড ট্রেড ভারতে থেকে ১৯ লাখ ৯১ হাজার ৩২০ কেজি ব্রোকেন স্টোন আমদানি করেন। যা বন্দরের টিটিআইতে সংরক্ষণ করা হয়। যার কাস্টমস মেনিফেস্ট নং-২৬৪১৩/১৭, ২৪৫১৬/১৩,২৫৫৩৬/১০,২৭৩০৮/৭ পণ্য চালানটি কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনারের (আইআর এম) নেতৃত্ব ইনভেন্ট্রি করে ১৭ লাখ ৯১ হাজার ৩২০ কেজি কম পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বন্দর কর্তৃপক্ষকে পত্র প্রদান করেছেন; যার পত্র নং-৫ম/২০(০৮)এলসি/নিলাম/বেনা-২০২০ /৫৮৭৬(১-৮)। নিলামকারী বেনাপোলের নোভা এন্টারপ্রাইজের মালিক মাহাম্মদ আলী খান বলেন, বন্দরের উপপরিচালক মামুন তরফদারের নেতৃত্বে বন্দরে একটি শক্তিশালী চোর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তিনি গত ২ বছর বেনাপোলে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বড় ধরনের পণ্য চুরির ঘটনা ঘটছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করেও কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে সহযোগিতা করছে এক যুগের অধিক সময় ধরে বেনাপোল বন্দরে কর্মরত থাকা সহকারী পরিচালক আব্দুল জলিল। বেনাপোলের ব্যবসায়ীরা জানান, চাকুরী বিধি লঙ্ঘন করে সহকারী পরিচালক আব্দুল জলিল এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ বন্দরে কর্মরত রয়েছেন। আর উপপরিচালক মামুন তরফদার রয়েছেন প্রায় তিন বছর যাবত। অথচ দুই বছরের বেশি সময় ধরে একই স্থানে এই কর্মকর্তার থাকার কোন বিধান নেই। বেনাপোলের একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকন্ঠের এই প্রতিবেদকের কাজে ক্ষোভের সাথে বলেছেন, মনে হয় ওই দুই কর্মকর্তাই এই বন্দরের মালিক। শুধু দুই কর্মকর্তাই নয়, বন্দরের বিভিন্ন সেড বা গুদামে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অধিকাংশই যুগ যুগ ধরে এখানে কর্মরত আছেন। দীর্ঘ দিন ধরে একই কর্মস্থলে থাকার সুবাধে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছে যে, বন্দর অভ্যান্তরের মধ্যে নানা ধরনের অবৈধ্য কর্মকান্ড চলে। অনেক স্টোরকিপার বা সেড ইনচার্জরা মাদকের কারবারও করেন। গত মাস খানে আগে ভারত থেকে আমাদকের একটি চালানও বন্দর অভ্যান্তরে আসার পরে সেগুলো স্টোর কিপারা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। পরে তা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গোপন সংবাদের ভিত্তিত্বে জানতে পেরে সেগুলো আটক করেন। জানা গেছে বেনাপোল বন্দরে কর্মরত এসব সেড ইনচার্জ বা স্টোরকিপারা বিগত চারদলী বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময়ে বন্দর নৌ-পরিবহন মন্ত্রী প্রয়ত কর্নেল আকবার হোসেনের সময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত। এদের অনেকেরেই সার্টিফিকেটও জাল বলে গুঞ্জন রয়েছে। যা তদান্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, বেনাপোল স্থলবন্দরে মোট ৪২টি সেড বা গুদাম রয়েছে। প্রতিটি সেড বা গুদামে স্টোরকিপার বা সেড ইনচার্জ থাকা সত্ত্বেও উল্লেখিত গুদাম গুলোতে ট্যান্ডেল বা এনজিও নামে বহিরাগত একজন করে চোর নিয়োগ দেয়া আছে গোপনে। তারা সরাসরি রাজস্ব ফাঁকি ও শেড থেকে মালামাল চুরির সঙ্গে জড়িত। সূত্রে থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়। আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৫০৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ হাজার ৫০৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বন্দরের প্রতিটি গেটে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্বে থাকার পরও অবাধে প্রবেশ করছে বহিরাগত। বন্দর একটি বন্ডেড কেপিআইভুক্ত এলাকা সত্ত্বেও কীভাবে বন্দরে অবৈধ লোকজন প্রবেশ করছে, তা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো মাথা ব্যথা নেই। বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, বন্দর থেকে পন্য চুরি হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। চুরি যাওয়া মালামালের কোন ক্ষতিপূরণ দেন না বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া বন্দরের উপ পরিচালক মামুন তরফদার ওপারে ভারতের বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতিদিন কত ট্রাক পণ্য আমদানি হবে তা অবহিত করার পর ভারত থেকে সেই সংখ্যক ট্রাক পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। ফলে ওপরে হাজার হাজার ট্রাক পণ্য আটক পড়ে থাকে। বেনাপোলের একাধিক সূত্র জানায়, বন্দরে কত ট্রাক পণ্য আমদানি হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে মামুন তরফদার, সে বন্দরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তার সাথে কাস্টমস ও রেল কতৃপক্ষের মধ্যে রশি টানাটানি হচ্ছে। ফলে প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। চুরি প্রসঙ্গে বন্দরের উপপরিচালক মামুন তরফদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য চুরির বিষয়টি সঠিক নয়। তাছাড়া এসব বিষয়ে তথ্য নিতে হলে বন্দরের পরিচালক আব্দুল জলিলের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। বিষয়টি নিয়ে বেনাপোল বন্দরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল জলিলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বলেন, বন্দর থেকে পণ্য চুরির অভিযোগ পাওয়ার পর বন্দরের উপপরিচালক মেহেদী হাসানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ২ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে। চুরির প্রসঙ্গে নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক জনকন্ঠকে বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বন্দরের নানা অনিয়ম নিয়ে আমরা বন্দরের বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে নিয়ে সমাধান করেছি। মামুন তরফদারের প্রসঙ্গে নিয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পণ্য চুরিসহ নানা অনিয়ম বন্দরে হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন। একই সাথে বন্দরের টিটিআই থেকে ব্রোকেন স্টোন ও ১নং শেড থেকে উন্নতমানের মূল্যবান ফেব্রিকস চুরি হওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। একের পর এক বন্দর থেকে পণ্য চুরির বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
×