ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আনুশকার মায়ের অনুরোধ

আমি আমার মেয়েকে হত্যার স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার চাই

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

আমি আমার মেয়েকে হত্যার স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের মেধাবী শিক্ষার্থী আনুশকা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার ৪ দফা দাবি জানিয়েছে তার পরিবার। এছাড়া মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে এ পৈশাচিক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তিসহ তিন দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। তাদের ভাষায়, রাজধানীর কলাবাগানের ডলফিন গলির একটি বাসায় যেভাবে কিশোরী আনুশকার ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে সেটা ছিল বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক। আনুশকার মা শাহেনূর আমিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার নিষ্পাপ মেয়েকে নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। চরিত্র হনন করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মিথ্যা প্রচারণাকারীদের সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে এ দাবি জানান, আনুশকার শোকাহত মা শাহেনূর আমিন। পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আরও কয়েকটি দাবি জানান তিনি। দাবিগুলো হচ্ছে, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ন্যায়বিচার করা, মামলা কার্যক্রম দ্রুত বিচার আইনে করা, দিহান ও তার সঙ্গীদের বিচারের আওতায় আনা, একটি স্বচ্ছ ডিএনএ পরীক্ষা কার্যকর করা এবং শিক্ষার্থীর পরিবার যেন কোন অযাচিত অসুবিধার শিকার না হয়, তার ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আপনি একজন মা। আমি আমার মেয়েকে হত্যার স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার চাই।’ এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকেও ৩ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাইবার মাধ্যম ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র শিশু-কিশোর ও তরুণের মানসিক বিকাশের উপযোগী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং ধর্ষণ, যৌন অপরাধের ঘটনা প্রতিরোধে পাঠ্যসূচীতে যৌন ও প্রজনন শিক্ষার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করাসহ এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এতে সেদিনের ঘটনা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীর মা বলেন, গত ৭ জানুয়ারি দিহান ও তার সঙ্গীরা আমার মেয়েকে অপহরণ করে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমার মেয়েকে অমানবিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার পর আমাকে ফোন করা হয়। দিহান আমাকে ফোন করে জানায়, সে (শিক্ষার্থী) সেন্সলেস হয়ে গেছে। আমি হসপিটালে এসে দেখি, দিহানসহ তার তিন সঙ্গী বসে আছে। তারা আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে ‘আন্টি আমাদের বাঁচান। যখন আমার মেয়েকে দেখতে চাই, তখন আমাকে দেখতে যেতে দেয়া হয়নি। কর্তব্যরত ডাক্তার আমাকে জানান, ‘শিক্ষার্থী মারা গেছে। পরে দিহানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আমার মেয়েকে তোমরা কোথায় পেলে, কেন মারা গেল ? তখন সে আমাকে বলে-আমরা চারজন ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই এবং সেখানে সে সেন্সলেস হয়ে যায়। তখন আবার জিজ্ঞেস করি, বাসায় আর কোনও মেয়ে ফ্রেন্ড ছিল না, বা তোমার বাবা-মা ছিল না? তখন বলে- না, আমরা চারজনই তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আমার বুঝতে বাকি থাকে না সেখানে কী হয়েছে। আমরা যেভাবে মামলাটি করতে চেয়েছি, পুলিশ সেভাবে মামলাটি নেয়নি। একটি মহল দিহান ও তার সঙ্গীদের আড়াল করার এবং আমার মেয়ের চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। বলা হচ্ছে, আমার মেয়ের সঙ্গে দিহানের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এটি একদমই ঠিক না। কিছু কর্মকর্তার সাক্ষাতকার বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আনুশকার বাবা আল আমীন বলেন, আমার মেয়েকে প্রতিটা মুহূর্তে আমি মায়ের মতো করে রেখেছি। আমার পারমিশন ছাড়া, অথবা আমার সঙ্গে কথা না বলে সে কোথাও কিছু করত না। ভবিষ্যতে প্রতিটা মুহূর্ত কী করবে সেটা আমার সঙ্গে কথা বলেই করতো। আমি আমার মেয়েকে সেভাবে গড়ে তুলেছি। এভাবে ওইদিনও যখন সে বিপদে পড়েছে, বা কোনও ডিসিশন নিতে হবে ভেবেছে, তখন আমাকে জানাতে ফোন করেছে। আমার কষ্টের বিষয় ওই মুহূর্তে আমি কলটা ধরতে পারিনি। যদি সে সময় কলটি ধরতে পারতাম, তাহলে হয়ত এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। আমার একটাই চাওয়া আমি যেটা হারিয়েছি, এটা যেন আর কোনও বাবা-মা কখনও না হারান। এ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডাঃ ফওজিয়া মোসলেম বলেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল’ গঠন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। ময়নাতদন্তে চিকিৎসক বলেছেন, শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু শিক্ষার্থীর মায়ের দেখানো একটি ছবিতে দেখা গেছে, পিঠে কালশিটে দাগ রয়েছে, যা ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, সহ-সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাসুদা রেহানা, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শিমা মুসলেম, ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মাহাতাব নেছা, ঢাকা মহানগর মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনুস প্রমুখ। এছাড়া ঘটনার শিকার ওই শিক্ষার্থীর চার সহপাঠীও উপস্থিত ছিল। দিহান যৌনশক্তি বর্ধক ওষুধ সেবন করেছে কিনা পরীক্ষা হবে ॥ মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী আনুশকাকে ধর্ষণকালে আসামি ফারদিন ইফতেখার দিহান (১৮) যৌনশক্তি বর্ধক কোন ওষুধ ও মাদক সেবন করেছেন কিনা তা পরীক্ষা করা হবে। বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পুলিশ পরিদর্শক আ ফ ম আসাদুজ্জামান পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম ইয়াসমিন আরা আবেদনটি মঞ্জুর করেন। আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা আসামি ফারদিন ইফতেখার দিহান ধর্ষণকালে কোন মাদক সেবন করেছিল কিনা তা জানার জন্য তার ডোপ টেস্ট করা প্রয়োজন। এছাড়া সে ধর্ষণকালে কোন যৌনশক্তি বর্ধক ওষুধ সেবন করেছিল কিনা এবং সেবন করলে কোন ধরনের ওষুধ সেবন করেছিল তা দিহানের রক্ত থেকে নমুনা সংগ্রহপূর্বক পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন। গত ৭ জানুয়ারি কলাবাগানের বাসায় আনুশকাকে ডেকে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন নিয়ে হত্যা করা করে দিহান। পরদিন ৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালতে দিহান দায় স্বীকার করে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এছাড়া ওই দিনই নিহত ছাত্রীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যালের ডাঃ সোহেল মাহমুদ বলেন, ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছে কিনা, তার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে কেমিক্যাল পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। এসব রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।
×