ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নেমে এলো

প্রকাশিত: ২১:০৮, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নেমে এলো

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে বর্তমানে ৬০টির বেশি তফসিলী ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু গত এক বছরে সব ব্যাংক মিলে এক লাখ কোটি টাকাও ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। ২০১৯ সালের নবেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বেসরকারী খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের নবেম্বর শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ২০ হাজার ৯০২ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত এক বছরে বেসরকারী খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নবেম্বরে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। যা বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে কম। ব্যাংক কর্মকর্তারা এই প্রবৃদ্ধিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি বলছেন। প্রসঙ্গত, ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশের বেশি। এরপর তা সব সময়ই ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এমনকি ২৫ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল এক বছরে। বেসরকারী খাতে কম ঋণের মানে হলো- বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন কমে যাওয়া। এতে কর্মসংস্থান ও সাধারণ মানুষের আয়ও কমে। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনাকালে বিনিয়োগ হচ্ছে না বলেই ঋণ বিতরণ কম। এ ছাড়া ব্যাংকও এখন দেখেশুনে ঋণ দিচ্ছে। ফেরত আসার নিশ্চয়তা আছে এমন খাতেই ঋণ দেয়া হচ্ছে। মহামারী করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তার ওপর ভর করে জুলাই- সেপ্টেম্বরে দেশে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে গতি এসেছিল। কিন্তু গত অক্টোবরে তা ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। অবশ্য প্রণোদনায় ভর করে নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ হয়। আগস্টে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। কিন্তু অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি কমে আবার ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, নবেম্বরে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। আগের অর্থবছরের নবেম্বরে হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, মহামারীর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের নবেম্বর শেষে দেশে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। এর মধ্যে বেসরকারী খাতে বিতরণ করা ঋণ ১১ লাখ ২০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। সরকার নিয়েছে এক লাখ ৯৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের নবেম্বর শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ১৬ হাজার ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যার মধ্যে বেসরকারী খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সরকারের ঋণ ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই হিসাবে গত নবেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারী ঋণের ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, আর বেসরকারী খাতে ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে সরকারী খাতেও। নবেম্বর শেষে সরকারী খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকায়। যা গত বছরের নবেম্বরের চেয়ে ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও এই একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল। তবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিনিয়োগ না থাকায় বেসরকারী খাতে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না বললেই চলে। জুলাইয়ের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই অবস্থায় কেউ বিনিয়োগে যেতেও চায় না। এ কারণে প্রণোদনার ঋণ ছাড়া ব্যাংকগুলো এখন অন্য কোন ঋণ বিতরণ করছে না। প্রণোদনার কারণে মাঝে কয়েক মাস বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এখন তা আবার কমে এসেছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে দেশের সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোয় ঋণ বাড়লেও বিদেশী ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কমেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিদেশী ব্যাংকগুলোর দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কমে হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। অবশ্য ৯ মাসে ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঋণ ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৯ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যে দেয়া ঋণ ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৫০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। চলতি মূলধন ঋণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৬ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। আর ভোক্তা ঋণ ৭০ হাজার ৯৭০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৭২ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। তবে ঋণ কমেছে কৃষি, মৎস্য ও বনায়ন খাতে। একইভাবে মেয়াদী ঋণও কমেছে।
×