ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দর্শক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ টিভি নাটক গন্তব্য কোথায়

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৭ নভেম্বর ২০২০

দর্শক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ টিভি নাটক গন্তব্য কোথায়

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘এখন টিভি দেখার সুযোগ তেমন হয় না। অথচ কোন এক সময়ে কাজের ফাঁকে টিভি নাটক দেখার সুযোগ করে নিতাম। সম্প্রতি এটিএন বাংলায় মীর সাব্বিরের ‘আলাল দুলাল’ নাটকের সিকুয়্যাল দেখছিলাম। পুনঃপ্রচার হলেও খুবই প্রিয় একটি নাটক। মাত্র শুরু হয়েছে, দুই মিনিট পরই টানা ৮ মিনিট বিজ্ঞাপন। তবুও ধৈর্য না হারিয়ে বিজ্ঞাপনের পর আবার দেখা শুরু করলাম। তিন মিনিট পরই আবার বিজ্ঞাপন। এবার আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না, রিমোট ঘুরাতে বাধ্য হলাম’Ñ একথা বলছিলেন রাজধানীর যাত্রবাড়ীর বাসিন্দা শওকত আলী। এ অভিযোগ শুধু একজন শওকত আলীর নয়। এমন অসংখ্য দর্শক দিনকে দিন টিভি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে এখন নাটক দেখার মাধ্যম বেড়েছে। অনেক ভাল ভাল নাটক দেখছে ইউটিউবে। সেখানে বিজ্ঞাপনের স্বেচ্ছাচারিতা আর মানহীন নাটক দেখার আগ্রহ দর্শক এক প্রকার হারিয়েই ফেলছে। অথচ এমন সময় ছিল ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘শুকতারা’, ‘সংশপ্তক’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রূপনগর’, ‘আজ রবিবার’, ‘জোনাকী জ্বলে’ ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশন পর্দায় উন্মুখ হয়ে থাকত দর্শক। নব্বইয়ের দশকেও দর্শকের বিনোদন চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়নি বিটিভি। বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল দর্শকের একমাত্র বিনোদনের ভরসা। নাটক দেখার পর গল্প বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় নিয়ে চলত আলোচনা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’র ‘বাকের’ চরিত্রকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ১৯৯৩ সালে ২২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায়। তখন নাটকে নয়, বাস্তবেই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে আন্দোলন হয়েছিল। নাটকের ইতিহাসে সত্যিই এটি একটি বিরল ঘটনা। দেয়াল লিখন হয়েছে ‘বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’। নাট্যকারের বাসার সামনে পোস্টার লাগানো হয়েছে, ‘কুত্তাওয়ালীর ফাঁসি চাই, বাকের ভাইয়ের মুক্তি চাই’। এ নিয়ে নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদকে ফোনে হুমকিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন কোন নাট্যকারের খোঁজও রাখে না দর্শক। নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী সময়ে একমাত্র টেরেসস্ট্রিয়াল চ্যানেল একুশে টেলিভিশন নানামাত্রিক নাটক দিয়ে মুগ্ধতায় ভাসিয়েছে পুরো দেশকে। ওই সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতার দর্শকও বাংলাদেশের চ্যানেলের ভালমানের নাটকগুলো দেখতে পছন্দ করত। অথচ ক্যাবল-স্যাটেলাইটের যুগে এখন কলকাতার দর্শকের বিটিভি বা অন্যান্য চ্যানেল দেখতে হয় না। নন-ফিকশন কিংবা রিয়েলিটি শোতে বাংলাদেশের টিভিওয়ালারা কখনও সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন না। বরাবরই ভরসার জায়গা ছিল নাটক। এখন সেই নাটক থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক। ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের দিকে ক্রমশ পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশীয় নাটকের দর্শক। পাশাপাশি দেশীয় বিজ্ঞাপন বাজারও এখন রফতানি হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে। অর্থনৈতিক দৈন্য আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যাচ্ছেতাই অবস্থা দেশের দুই ডজনেরও অধিক টিভি চ্যানেলে। দিনকে দিন বেড়ে চলেছে মানহীন নাটকের সংখ্যা। মাঝেমধ্যে দু-একটি ভাল মানের নাটক সম্প্রচার হলেও লাগামহীন বিজ্ঞাপনের কারণে রিমোট হাতে স্থির থাকছে না দর্শক। বিটিভির ওপর থেকে দর্শক আকর্ষণ হারিয়েছে অনেক আগেই। ভরসা ছিল স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। কিন্তু সেখানেও চলছে নাটকের নামে বিরামহীন বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। তার ওপর বেশিরভাগ নাটকই গল্পহীন-অর্থহীন। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের টিভি নাটকের ভবিষ্যত কী? এখন কি আর ভাল নাটক নির্মাণ হয় না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বনামধন্য নাট্যকার নির্মাতা ও প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবশ্যই, এখনও ভাল নাটক নির্মাণ হয়। না হলে এতগুলো চ্যানেলে এত এত নাটক চলে কী করে? এ প্রসঙ্গে নাট্যজন আলী জাকের বলেন, একই টিভি চ্যানেলে কতিপয় নাট্যকারের নাটক দীর্ঘদিন চালালে গল্পের নতুনত্ব কমে যায়। আমাদের দেশে সেটিই হচ্ছে। গল্পের বৈচিত্র্য না থাকলে তো দর্শক টানা যায় না। টিভি নাটকের মান নিয়ে বলাও মুশকিল, কেননা এতগুলো চ্যানেলের জন্য প্রোগ্রাম দরকার হচ্ছে এবং সেগুলো যার যে রকম মেধা তাই দিয়ে তৈরি করছে। যার ফলে নাটকের মানও নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার একগাদা লোক এর ওপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালায়, তাদের কথাও ভাবতে হবে। সমস্ত দিক এখন একটা সুতোয় জড়িয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের মতো ভাল লেখক আসলে কিংবা ইমদাদুল হক যদি আবার যত্ন নিয়ে লিখতে আরম্ভ করে তখন দর্শক এদিকে ফিরবে। এখন নতুন কোন পথ সৃষ্টি করতে না পারলে এর উত্তরণ ঘটবে না। আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যদি একটু ভাল বা শক্তিশালী হতো, যেটাকে বলা হয় লেজে হাওয়া পাওয়া, তাহলে হয়তো এদিকটা ভাল হতো। মুশকিল তো ওইখানে, এখন দর্শককে যা দেয়া হয় তাই দেখে। তবে টিভি নাটক একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, পত্র পত্রিকায় নাটক নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়। ফলে চলছে কোন রকমে। এখানে যারা নাটক লেখে, তৈরি করে, অভিনয় করে সেটাই তাদের পেশা। তাদের দেখতে হয় কোন নাটকটা কিভাবে করলে জনপ্রিয় হয়। সেখানে একটা দ্বন্দ্ব লাগে। সেই সম্পর্কে হয়তো একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমি মনে করি টিভি নাটকে বৈচিত্র্য আনতে হবে, তাহলে দর্শকপ্রিয়তা পাওয়া যাবে। বাজেট সঙ্কট এবং বিজ্ঞাপনের দৌরত্ম্যের কারণে টিভি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক, বললেন আরেক নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ভালর দিকে যাচ্ছে না আমাদের দেশের টিভি নাটক। নাটকে বাজেট নেই। এত নাটকের চাপ, ভাল শিল্পী, টেকনিশিয়ান কম যার ফলে ভাল নাটক হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে ওয়েব সিরিজ শুরু হয়েছে। ইউটিউবে দর্শক নাটক দেখে। কাজেই মানুষের মনোযোগ ওই দিকে যাচ্ছে। ওটাতে বাজেটও বেশি। আজকের দিনে তো সব কিছুর পেছনে টাকা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর এতে এজেন্সি ঢুকে গেছে। তারা প্রচুর মুনাফা করে। একচুয়ালি প্রডিউসার, ডিরেক্টর ও শিল্পীর হাতে যে টাকাটা পৌঁছায় সেটা একেবারেই অপ্রতুল। টিভির বিশৃঙ্খলা তো আছেই। আর বাংলাদেশের নাটক দর্শক কেন দেখবে? নাটক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে পরিমাণে বিজ্ঞাপন চলে। ২০ মিনিটের নাটকে যদি ৪০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে কে দেখবে নাটক? টিভি চ্যানেল বা এজেন্সি থেকে বলা হয় ওমুখ শিল্পীকে নেন, তা না হলে হবে না। এজেন্সির দৌরাত্ম্যে তাদের রেটও বেশি। নাটকে যে সব আর্টিস্টদের আমরা দেখি এদের দেখতে চায় না দর্শক। চ্যানেলগুলোর ভাল নাটকের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তারা শুধু টাইমকে ভরাতে চায়। কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মামুনুর রশীদের কথার সঙ্গে একমত নন স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এখন তো বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। ওই কথা এখন আর কেউ বলতে পারবে না। আমরা দেখেছি যে ভাল নাটকে বিজ্ঞাপন থাকলেও দর্শক সরে যায় না। টিভি নাটকে দর্শকের আগ্রহ কমে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দর্শকের আগ্রহ কমে আসছে না। যারা ভাল নাটক বানাচ্ছে তাদের নাটক অবশ্যই দেখছে। যেমন ধরুন আমাদের আরটিভির নাটকগুলো ডিফারেন্ট হয়। মানুষ এ নাটক দেখার জন্য টিভির সামনে বসে থাকে। সে জন্য আমাদের সিআরপিও ভাল। এখন যদি আপনি নাটক বানানোর নামে আলতু-ফালতু জিনিস তৈরি করেন, তাহলে তো মানুষ দেখবে না। দর্শকের সঙ্গে তো প্রতারণা করা যায় না। দর্শককে ভাল জিনিন দিলে দেখবে, না দিলে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তিনি বলেন, আমাদের আরটিভির নাটকের দারুণ ডিমান্ড আছে। মানুষ দেখছে কোন অসুবিধা নেই। আমরা নাটক বানাচ্ছি ভাল। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে টেলিভিশন নাটক না বানিয়ে তার বাইরে কিছু ব্যবসায়িক নাটক বানাচ্ছে। ওই জায়গায় সমস্যা। কারণ যারা অতি লাভের জন্যে ওই কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করছে, যার জন্য ভাল কিছু হচ্ছে না। যারা আমরা নিজেরা টেলিভিশনে বানাচ্ছি সেগুলো ভাল হচ্ছে। আমাদের ডিরেক্টর ও প্রডিউসার নিজে তত্ত্বাবধান করে নাটকগুলো বানায় যার জন্য আমাদের নাটকের মান ভাল হয়। নাট্যজন ড. ইনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রযুক্তির কারণেই দর্শক বাইরের নাটক দেখছে। তবে আমাদের দেশের নাটকগুলো বিষয়ের ওপর তেমন কিছু চমকপ্রদ দিতে পারছে না। নাটক যে দর্শক একেবারে দেখছে না তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে এক খণ্ডের নাটকগুলো দেখে। আমি মনেকরি, আমাদের টিভি চ্যানেল যারা চালাচ্ছে তাদেরও অনেকটা চয়েজি হতে হবে। যা ইচ্ছে তাই অনইয়ার করে দিলে বা ভার জিনিস না দিলে দর্শক বিমুখ হয়ে যায়। যথেচ্ছ আঞ্চলিক ভাষা আমাদের নাটককে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারকেন্দ্রির নাটক তেমন হচ্ছে না। কলকাতার নাটক কেন দেখে, সেখানের বেশিরভাগ নাটকের ধারাবাহিকতা আছে। মোটামুটি সব ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি আছে। যেগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করা উচিত। আঞ্চলিকতা হয়তো অল্প বয়সীদের ভাল লাগতে পারে, কিন্তু ভাল নাটকের জন্য ভাল গল্প ও সংলাপের প্রয়োজন। নাটকের ক্ষেত্রে আমাদের ডিসিপ্লিনের অভাব। সবাই মিলে এর কারণগুলোকে সলভ্ করা প্রয়োজন।
×