ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হযরত আয়ংশা (রা.)র ঘরেও ঘোড়ার মূর্তি ছিল। রসূল (সা.) নিষেধ করেননি ইসলামী জোটের সংবাদ সম্মেলনে আলেম হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান

‘মুর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়’

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ২২ নভেম্বর ২০২০

‘মুর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভাস্কর্য স্থাপনকে মূর্তি স্থাপনের সঙ্গে তুলনা করে এটাকে শিরক সংস্কৃতি বা বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে আখ্যা দেয়াকে ‘মামা বাড়ির আবদার’ বলে অভিহিত করেছেন দেশের প্রখ্যাত আলেম হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান। সম্মিলিত ইসলামী জোট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সকল ধর্মের মর্যাদা রক্ষার আহবান জানিয়ে প্রখ্যত এ আলেম বলেন, হযরত আয়ংশা (রা.) এর ঘরেও ঘোড়ার ছোট মূর্তি রাখা ছিল। কই, রসূল (সা.) তাকে তো নিষেধ করেননি। ধর্মের নাম নিয়ে সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং গুজব রটিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সেরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, কারণ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে (ইতিপূর্বে) অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। রবিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান এসব কথা বলেন। ‘মহান আল্লাহ-পবিত্র কুরআন-মহানবীকে (সা.) কটুক্তির প্রতিবাদের সীমারেখা এবং আমাদের করণীয় ও ভাস্কর্যকে মূর্তি পূজার সঙ্গে তুলনা করার পোস্টমর্টেম’ শীর্ষক ওই সংবাদ সম্মেলনে কুরআন ও হাদীসের আলোকেও তিনি বিভিন্ন ব্যখ্যা দেন। ভাস্কর্য ও মূর্তি শব্দের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে যারা অপরাজনীতির চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘গোঁড়া তালেবানি ভাবধারায় ভাস্কর্য নির্মাণ নিষিদ্ধ- হেফাজতিরা সম্পূর্ণভাবে অ-ইসলামী সেই ভাবধারা প্রবর্তনের কথা বলছে। এখনকার যে হেফাজতে উগ্রপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, তালবানপন্থী, জঙ্গি এবং প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী অংশ নেতৃত্বে আসছে। এ দেশের মানুষ আপনাদেরকে ৭১ সালেও চিনতে ভুল করেনি, এখনও করবে না। ভাস্কর্য বা মুর্তী মানেই শিরক নয়। বিশ্বের অনেক ইসলামি দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। হেফাজতিরা যদি ভাস্কর্য বিরোধীই হয়, হাটহাজারীর কাছেই খাগড়াছড়ি শহরের দ্বারপ্রান্তে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের একটি বৃহদাকার ভাস্কর্য রয়েছে। মানুষের এই মূর্তি ভেঙে এরা প্রমাণ করতে পারেন এ বিষয়ে তারা কতটা সিরিয়াস।’ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, দীর্ঘদিন যাবত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্লিপ্ততায় উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ধর্মের নামে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং তার চত্বরে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। মসজিদ একমাত্র ইবাদতের জায়গা। ইবাদত বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সরকার প্রশাসনিকভাবে নিষিদ্ধ করবেন এটাই আমাদের দাবি। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জোটের সহ-সভাপতি মুফতি জোবাইদ আলী, ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ আব্দুস সোবহান মিয়া, সাধারণ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা আবুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মোসলেহ উদ্দিন ফোরকান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অধ্যক্ষ মাওলানা ফারুক হোসাইন, মুফতি মাওলানা শরীফ হোসাইন প্রমুখ। মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, বাঙালি সংস্কৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতি নয়, এটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিতে যেসব জিনিস শিরক বা আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদিতার মিশ্রণ ছাড়াই পালিত হয়ে আসছে, সেটিকে হঠাৎ করে শিরক সংস্কৃতি বলা নোংরা রাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়। বুখারি শরিফের শুরুতেই রয়েছে বিখ্যাত হাদিস, “ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়্যাত (নিয়তের উপর কাজ নির্ভরশীল)"। মূর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়। হযরত আয়শা (রা.)-এর ঘরে ঘোড়ার ছোট মূর্তি রাখা ছিল (সূত্র: বুখারি শরিফ-কিতাবুল আদাব)। কই, রসূল (সা.) তাকে তো নিষেধ করেননি। এই ছোট পুতুল বা মূর্তি পূজার জন্য ছিল না; বরং খেলার জন্য ছিল। তাই রসূল (সা.) নিষেধ করেননি। একইভাবে যেসব ভাস্কর্য সৌন্দর্য্য চর্চা ও রুচিশীলতার পরিচয় বা ঐতিহাসিক কোনও ঘটনার স্মৃতিফলক হিসেবে স্থাপিত হয়, তা ইসলামি শিক্ষানুযায়ী নিষিদ্ধ নয়।’ তিনি বলেন, ভাস্কর্য, প্রতিমা পূজা, মূর্তি এক জিনিস নয়। পবিত্র কোরআনের সূরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতে ভাস্কর্য নির্মাণের উল্লেখ করে বলা হঢেছে, “উহারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযাযয়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্যসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃড়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করিতো। আমি বলিয়াছিলাম, হে দাউদ-পরিবার, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করিতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ”। প্রতিমা পূজার বিষয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা ইব্রামিমের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ কর, ইব্রাহিম লিয়াছিলেন, হে আমার প্রতিপালক, এই নগরীকে নিরাপদ করিও এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা হইতে দূরে রাখিও। সূরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতের তামাসিলা (ভাস্কর্য) এবং সূরা ইব্রাহিমের ৩৫ নম্বর আয়াতের আসনাম (প্রতিমা পূজা) এই দুটি শব্দের অর্থকে বিকৃত করে যারা একই অর্থে মূর্তিকে ভাস্কর্য বানাতে চাচ্ছেন, তাদের বলবো অনুগ্রহ করে কোরআনের শব্দের অর্থকে ভুল ব্যাখ্যা করে মাঠ গরম করার চেষ্টা করবেন না। কারণ এ দেশের মানুষ আপনাদের ‘৭১ সালেও চিনতে ভুল করেনি, এখনও করবে না। ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের নামে স্থাপিত স্মৃতি ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে যখন বাংলাদেশের মুসলমানরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তখন তারা কেউই সেখানে ইবাদতের নিয়তে বা প্রার্থনার নিয়তে যান না। সেখানে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শহীদদের ত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় মাত্র। মূতি বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ নয় দাবি করে সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি আরও বলেন, ‘যেটি যে উদ্দেশ্যে বানানো হয়, সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে। হযরত মা অয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসুল (সা.) এর প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তার কয়েকটি পুতুল ছিল বলে হাদিসে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তার বান্ধবীদের সঙ্গে এসব পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। কই, মহানবী (সা.) তো তাকে শিরক বলে এসব পুতুল নিয়ে খেলতে বারণ করেননি। আবার এসব পুতুল শিরকের উপরণ এমন কথাও কখনও বলেননি। রাসুল (সা.)-এর বাসগৃহে পুতুলের অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে, পুতুল বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ নয়। কট্টর ওয়াহাবিপন্থী হুজুররাও এটি জানেন, ভাস্কর্য মানেই শিরক নয়। সৌদি আরবের জেদ্দার মূল কেন্দ্রে ‘দি ফিস্ট’ নামে একটি ভাস্কর্য আছে, এটি একটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভাস্কর্য। আরও আছে ঘোড়ার ও মাছের ভাস্কর্য; একইভাবে মুসলিম অধ্যুষিত সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও মিশরে রয়েছে ঘোড়া ও অন্যান্য জীবের ভাস্কর্য। চরমোনাই পীর মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করীম এবং হেফাজতের নেতা মামুনুল হককে উদ্দেশ করে মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, আমরা বলবো, আপনাদের দেশবিরোধী এই সব আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য জনগণের মেনডেট নিয়ে সংসদে গিয়ে বিল উত্থাপন করে তা পাশ করুন।’ ইসলামী জোটের সভাপতি বলেন, ধর্মের নাম নিয়ে সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং গুজব রটিয়ে তাদের রাজপথে নামিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করা ধার্মিকতার লক্ষণ নয়। সরকারকে বলবো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশের শিক্ষাবিদ ও দেশপ্রেমিক ইসলামি চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে বিজ্ঞানভিত্তিক এককেন্দ্রিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা চালু করা, জাতীয় চিন্তা-চেতনায় সব শিক্ষার্থীকে এক-অভিন্ন মনস্কে গড়ে তোলা। বিশ্বায়নের সামগ্রীক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্য নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে।
×