ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন ঝুলে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:০১, ১৯ অক্টোবর ২০২০

লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন ঝুলে যাচ্ছে

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ঝুলে যাচ্ছে। কেননা, বিশ্বের শক্তিধর কয়েক রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাসমূহ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে বর্তমান সময়ে প্রাধান্য না দিয়ে তাদের জন্য আগামী ১০ বছরের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রে এ ঘটনাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করা হচ্ছে। সঙ্গে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের অব্যাহত টালবাহানা এবং বর্তমানে নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিঃসন্দেহে এ দেশের জন্য মারাত্মক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে আছে। এরইমধ্যে বৃহৎ শক্তি ও দাতারা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে পেছনে ফেলে রেখে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা হিসেবে আগামী দশ বছরের জন্য কর্মসূচী গ্রহণের তৎপরতায় নেমেছে। আগামী ২২ অক্টোবর এ সংক্রান্তে ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ। এর পাশাপাশি চীনের রাজধানী বেজিংয়ে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠকেরও আয়োজন হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন, দাতারা ফেইজওয়াইজ আগামী দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপে তৎপর। দাতারা আরও বলেছে, মাল্টিইয়ার প্ল্যানিং নিয়ে। কিন্তু এ ধরনের প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা থাকবে না বলে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য মানবিক সহায়তা নয়, প্রত্যাবাসন। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। শুরুর দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক বলে জানিয়ে দুদফায় দিনক্ষণ ধার্য করে। কিন্তু মিয়ানমারের এ পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যথাযথ পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে আওয়াজ ওঠে আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এরপরে কিছুদিন চলে তালিকা চালাচালি। বাংলাদেশের পক্ষে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দফায় দফায় তালিকা প্রেরণ করা হয়। মিয়ানমার পক্ষ সেখান থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গা তাদের নয় বলে জানান দেয়। এমনিতর পরিবেশে একপর্যায়ে পুরো প্রক্রিয়াটি মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশ পক্ষ যতই তৎপরতা দেখায় বিপরীতে মিয়ানমার ততই পিছিয়ে যায়। বার বার জানান দিতে থাকে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। নাগরিকত্বের সনদ ছাড়া তারা কাউকে ফেরত নেবে না। এ প্রক্রিয়ায় পানি বহুদূর গড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় প্রাথমিক নির্দেশনা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে প্রতীয়মান এতে মিয়ানমারের তেমন কিছু আসে যায় না। এদিকে, ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বর্তমান পরিস্থিতি নাজুক। কক্সবাজারে ৩৪ শিবিরে এ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ফ্রিতে খাচ্ছে, থাকছে। দেশী-বিদেশী সহায়তা নিয়ে এরা আরাম-আয়েশেই দিন কাটাচ্ছে। এছাড়াও কক্সবাজারের আশপাশ এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সন্ত্রাসী তৎপরতাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত। মানব ও মাদক পাচারের পাশাপাশি বহু রোহিঙ্গা সদস্য এদেশের আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলো রোহিঙ্গাভারে বিপর্যস্ত। স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। আশ্রিত অবস্থায় থেকে এরা বেআইনী অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। এদেরকে সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রীতিমতো হিমশিম অবস্থায় রয়েছে। সঙ্গত কারণে সরকার এদেরকে যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাবাসন করার জন্য প্রতিনিয়ত বিশ্ব দরবারে আবেদন নিবেদন করেই চলেছে। দফায় দফায় এ ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়ে নানা প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে এটি বাতিল হয়ে যায়। গত প্রায় তিন বছর ধরে এ অবস্থা চলছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, দাতা সংস্থার শীর্ষ পদের কর্মকর্তা, শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাসমূহের কর্মকর্তা রোহিঙ্গা শিবির সফর করে প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করেছেন। তারা নিজ কানে শুনেছেন রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াওয়ের বর্বর ঘটনাবলী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতের পর সে দেশের সেনাবাহিনী কিভাবে রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে হামলে পড়ার বহু ঘটনা রূপ কথার কল্প কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ভিটেবাড়ি বুলডোজারে মাটি চাপা পড়ায় কোন চিহ্ন নেই। রোহিঙ্গা পল্লীগুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন নতুন বৌদ্ধ পল্লী আর পুলিশ ও সেনা চৌকি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার উৎকণ্ঠিত। আশ্রয় শিবিরের আশপাশ এলাকার মানুষ দিন দিন ফুঁসছে। কারণ, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কারণে সেখানকার পরিবেশ বিপর্যস্ত। এলাকাবাসীর চাষাবাদের জায়গা জমি রোিহঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ব্যাপক। এছাড়া রোহিঙ্গা তাদের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাম্পে না থেকে পুরো এলাকাজুড়ে চষে বেড়ায়। এসব ছাড়াও ক্যাম্প অভ্যন্তর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নিয়ে ঠাঁসা। মিয়ানমারে থাকাকালে যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে এদের কিছু অংশ এদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়ে ক্যাম্পের পরিবেশকে সম্পূর্ণভাবে আতঙ্কজনক করে তুলেছে। এদের রয়েছে গোলা বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র। এরা একদিকে মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা পাচার এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মানব পাচারেও জড়িত। এসব বিষয় নিয়ে কক্সবাজার অঞ্চলের উখিয়া টেকনাফের পরিস্থিতি নাজুক। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বহু সদস্য নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এরপরও এরা থামছে না। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়ত নানা অঘটনের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। সারা বিশ্বকে প্রতিনিয়ত এ বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য আবেদন করে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশও মিয়ানমারকে তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নানাভাবে আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার এতে থোড়াই কেয়ার করছে না। উল্টো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক আখ্যা দিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। এমনিতর পরিবেশে চার দাতা দেশ ও সংস্থার উদ্যোগে আগামী ২২ অক্টোবর যে ভার্চুয়াল সম্মেলন হচ্ছে তাতে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই আলোচনার সর্বাগ্রে থাকার কথা। কিন্তু এসব দাতা দেশ ও সংস্থা কি কারণে মানবিক সহায়তার জন্য এত তৎপর হলো তা নিয়ে ইতোমধ্য বিভিন্ন মহলে নানাজিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। দাতা দেশসমূহের পক্ষে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারে এখনও অবস্থানরত এবং বিভিন্ন দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির আবেদন জানানো হবে ভার্চুয়াল সম্মেলনে। এমন তৎপরতা বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের পক্ষে এখন একটাই বক্তব্য, আর মানবিক সহায়তা নয়, প্রত্যাবাসনই মুখ্য।
×