ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোমল পানীয়ের নামে আমরা কী খাচ্ছি?

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১ অক্টোবর ২০২০

কোমল পানীয়ের নামে আমরা কী খাচ্ছি?

শাহীন রহমান ॥ নকল ও মানহীন কার্বোনেটেড বেভারেজের (কোমল পানীয়) রমরমা ব্যবসা চলছে। এসব পণ্য উৎপাদনে বিএসটিআইয়ের কোন অনুমোদন নেই। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান লাইসেন্স ছাড়াই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে এসব পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। অনুমোদন না থাকলেও এসব পণ্যের বাজারজাতের সময় বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ক্রেতা বা ভোক্তা না জেনেই এগুলো কিনে প্রতারিত হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কোমল পানীয়ের নামে আমরা আসলে কী খাচ্ছি? জানা গেছে, এসব পণ্যের বেশিরভাগ উৎপাদন কারখানা রয়েছে রাজধানীর পার্শ¦বর্তী এলাকায়। বিশেষ করে গাজীপুর এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও আশুলিয়ায় অসংখ্য অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখান থেকে এসব পানীয় উৎপাদিত হয়েছে দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যায়। বিএসটিআইয়ের অনুসন্ধানের দেখা গেছে অনেক সময় দেশের অনুমোদিত বেভারেজ কোম্পানির নামেই এগুলো বাজারজাত করা হয়। আবার অন্য নামেও বাজারজাত করা হচ্ছে। অনেকে আসল নকল না বুঝেই এটি পান করে থাকেন। নিম্নমানের এসব পানীয় গ্রহণে মানব স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা মঈনুদ্দীন মিয়া জানান, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের একটি টিম ঢাকা আশুলিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এতে দেখা যায় বিএসটিআই লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতীত এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে লোগো ব্যবহার করে কার্বোনেটেড বেভারেজের নামে নকল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন আউকপাড়া, দশদাহী এলাকায় গ্রুপ জি-৫০ বেভারেজ লিমিটেড থেকে রয়েল টাইগার ও স্পিডের আদলে প্রস্তুতকৃত বিপুল পরিমাণ এসব নকল ও মানহীন কার্বোনেটেড বেভারেজ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত পানীয়ের মধ্যে আরও রয়েছে রিয়েল টাইগার, ব্রেক আপ, রয়্যাল টাইগার, স্পিড, ডেল্টা অরেঞ্জ, জি-৫০ ব্রান্ডের কার্বোনেটেড বেভারেজ। অথচ এসব পণ্য উৎপদনের বিএসটিআইয়ের কোন অনুমোদন নেই। বাজারজাতের কোন লাইসেন্স নেই। ঢাকা ঢাকার আশুলিয়া নয় ॥ রাজধানীর ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার কিছু স্থানে অনুমোদনহীন এসব কার্বোনেটেড বেভারেজ কোম্পানি রয়েছে। যেখানে ঘনচিনি ও স্যাকারিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই সফট ড্রিংকস। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে পাউডার বানিয়ে ড্রামে ভরে রাখা হয়। এগুলো পরে জমাট বেঁধে গন্ধযুক্ত হয়। এর মধ্যে চিনির গুঁড়া ও রং মিশিয়ে তৈরি করা হয় সফট ড্রিংকস। এর মধ্যে কমলার সেন্ট বা আমের সেন্ট দিলে কমলা বা আমের ড্রিংসে পরিণত হয়। রাজধানীর উত্তরখান এলাকা, কামরাঙ্গীরচর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এমন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময় এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও সুযোগ বুঝে আবার নকল সফট ড্রিংকসের উৎপাদন শুরু করে দেয়। নকল ও নিম্নমানের সফট ড্রিংকসমূলত গ্রাম এলাকায় পাঠানো হয়। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কাছে এটি অতি লোভনীয়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, যে কোন ড্রিংকস উৎপাদন ও বোতলজাতের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্ধারিত ১২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল উপকরণগুলো ফুটিয়ে নিয়ে তা রিফাইন করার মাধ্যমে সংমিশ্রণ ঘটানো এবং বোতলজাত করা থেকে মুখ লাগানো পর্যন্ত সবকিছুই অটো মেশিনে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু কথিত জুস, নিম্নমানের ড্রিংকস উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানাগুলোতে সবকিছুই চালানো হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে। ন্যূনতম মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সেখানে নেই। তারা জানান দেশের ৫০ অধিক প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের কাছে লাইসেন্স নিয়ে কোমল পানীয় বা কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদন করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতের জন্য বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স রয়েছে। তারা জানান প্রতিবছর অনুমোদিত কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মান পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে কোন ধরনের অনুমোদন না নিয়েও এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনও বিপণন করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযান চালানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তারপরও অনেকে অনুমোদন না নিয়ে এই ধরনের পণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে যা নিরাপদ খাদ্য আইনে অপরাধ। বিএসটিআইয়ের অনুমোদনের বাইরের গিয়ে কাউকে কোমল পানীয় উৎপাদন এবং বাজারজাতের কোন সুযোগ নেই। যারা লাইসেন্স ছাড়াই এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। এজন্য রাজধানী ও পার্শ¦বর্তী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বা কোন কারখানায় এ ধরনের পণ্য উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা, প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে। এরপরও কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে গোপনে এ ধরনের পণ্য উৎপদনের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালানা করা হবে বলে তারা জানান। সৌখিন বা জনপ্রিয় পানীয় খাদ্যপণ্য হিসেবে পরিচিত কার্বোনেটেড বেভারেজ। যা কোমল পানীয় বা সফট ড্রিংক হিসেবে পরিচিত। খাবারের তালিকায় কোমল পানীয়ের আবশ্যিক ব্যবহার রয়েছে দেশে। এর বাইরের বিভিন্ন ঘরোয়া বা সামাজিক অনুষ্ঠানে এটির অধিক ব্যবহার করতে দেখা যায়। দেশে বৈধভাবে যেমন সফট ড্রিংকস উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে, তেমনি অনুমোদন ছাড়াও নিম্নমানের উপকরণ মিশিয়ে কোমল পানীয় তৈরির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে যেসব সফট ড্রিংক বা কার্বোনেটেড বেভারেজে উৎপাদনের অনুমোদন রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে পেপসি, পেপসি ডায়েট, পেপসি কোলা, সেভেন আপ, সেভেন আপ লাইট, ম্যারিন্ডা অরেঞ্জ, মাউন্টেইন ডিউ, স্টিং, ইভারভেস, আরসি কোলা, আরসি লেমন, আরসি অরেঞ্জ, আরসি কোলা ডায়েট, বিগ বস, রয়্যাল কোলা সোডা, চিয়ার আপ, ম্যাক্স কোলা, ম্যাক্স লেমন, অরেঞ্জ লেমন, কোনিয়া লিচিনা, ইউরো (লেমন অরেঞ্জ কোলা), রয়্যাল টাইগার, ফিজ আপ, ব্ল্যাক হর্স, র‌্যায়াল টাইগার ডায়েট, ইউরো অরেঞ্জি, ইউরো লেমনঞ্জি, প্রাণ আপ, ফাইভফ্লাই, ট্যাঙ্গো (অরেঞ্জ, ম্যাঙ্গো, লিচি), কালার (অরেঞ্জ, লেমন), পাওয়ার, বুলেট, কোকাকোলা, রেস, স্প্রাই, স্প্রাই অরেঞ্জ, লেমন, লায়ন কিং, পপস সাইডার (গ্রীন মেলন, পাইন আপেল, ম্যাঙ্গো), বুমবুম, বাফালো লেমন আপ, বাফালো কোলা ক্লাসিক, বাফালো লেমন আপ, উইংস, এ্যাহ কোলা, জি-৫০, ওডি (অরেঞ্জ) ম্যাক্স কোলা, ম্যাক্স লেমন, চিয়ার আপ, কোলাকোলা স্পাইট, ফান্টা, পোকোলোকো, ফ্রেক (ধুম কোলা গুগলি সউল আপ, ম্যাজেন্ডা, ক্লাব সেভেন সোডা,) গিয়ার, স্পাইট, স্পাইট জিরো সুগার, ফান্টা কোলাকোলা, কোলোকোলা জিরো, ডায়েট কোক, থাম্বস, আপ চার্জ, ফানটা লিচি ফ্লেবার, জিল আপ, জিল অরেঞ্জ, জিল কোলা চাঙ্গা, ইউরো (লেমন, অরেঞ্জ, কোলা), দেশবন্ধু (কোলা লেমন), নেকটার (লেমন, অরেঞ্জ) প্রভৃতি। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদিত এসব পণ্যের বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান এসব পণ্যের নাম ব্যবহার করে আবার কখনও লাইসেন্স না নিয়েই অন্য কোন নামে পণ্য বাজারজাত করছে যা বিএসটিআইয়ের আইনে অপরাধ।
×