ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা যুগের নতুন রাজনীতি

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ৯ জুলাই ২০২০

করোনা যুগের নতুন রাজনীতি

লন্ডনের ‘ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বর্তমান যুগকে ‘আনসারটেন এইজ’ বা অনিশ্চিত যুগ আখ্যা দেয়া হয়েছে। যে যুগে জীবন মৃত্যু, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সভ্যতা সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এ যুগটাকে করোনা-যুগও বলা যেতে পারে। যে যুগে প্রকৃতি মানব সমাজকে কঠোরভাবে শাসন করছে এবং এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, প্রকৃতিকে না বাঁচাতে চাইলে প্রকৃতিও মানব সমাজকে বাঁচাবে না। প্রকৃতি যে মানব সমাজকে বাঁচায় তার একটা বড় প্রমাণ, যে সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন নিয়ে আমরা হাসি ঠাট্টা করি, সেই সুন্দরবন এবার ভয়াবহ ঝড় থেকে বাংলাদেশকে অনেকটা রক্ষা করেছে। আগেও করেছে। তা আমরা গণনায় ধরিনি। এবার বিশ্বের প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন, সুন্দরবন ঝড়কে প্রতিহত না করলে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় যে ধ্বংসকা- ঘটেছে, তা আরও দশগুণ হতো। বাংলাদেশের এবারের বাজেটে জলবায়ু রক্ষা, পরিবেশ দূষণ ঠেকানো (ক্লাইমেট প্রোটেকশন, এনভায়রনমেন্ট) খাতে পর্যাপ্ত অর্থ রাখা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কোভিড-১৯ মহামহামারী এবার বিশ্বের ধনী-গরিব সকল দেশকে একটা ওয়ার্নিং দিয়েছে, তাদের বাজেটে সামরিক খাতে, অস্ত্র ক্রয় অথবা অস্ত্র নির্মাণ খাতে সিংহভাগ অর্থ বরাদ্দ চলবে না। অর্থ বরাদ্দ করতে হবে স্বাস্থ্য, জলবায়ু উন্নয়নের কাজে। অর্থাৎ, প্রকৃতি এবং জনজীবনের উন্নতি ঘটানোর কাজে। নইলে প্রকৃতি মানব সমাজকে করোনার চাইতেও ভয়াবহ চরম দ- দেবে। অনেক প্রকৃতি বিজ্ঞানী বলছেন, করোনাসহ যে নতুন নতুন রোগ জীবাণু এখন সারা বিশ্বে ছড়াচ্ছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। পরিবেশ দূষণের ফল। ইতোপূর্বে প্রকৃতি মানুষকে এ সম্পর্কে বহু ওয়ার্নিং দিয়েছে। বলেছে বিশ্বের ক্লাইমেট বিপজ্জনকভাবে উষ্ণ হচ্ছে। নদী ও সমুদ্রতল ভরাট হচ্ছে। মানুষ তা খনন করছে না। নির্বিচারে গাছপালা ও বনের পশু পাখি ধ্বংস করছে। বাংলাদেশে বনসম্পদ যত কাটা হচ্ছে, বৃষ্টিপাত তত কমছে। আন্তর্জাতিক ক্লাইমেট চেঞ্জ সম্পর্কিত অধিবেশনগুলোতে শেখ হাসিনা আক্রান্ত ছোট দেশগুলোর পক্ষ থেকে সবচাইতে জোরালো ভাষায় বড় দেশগুলোর উদাসীনতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ‘মাদার অব আর্থ’ খেতাব পেয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ক্ষমতা-অন্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্প তো করোনার মতো ক্লাইমেট চেঞ্জের মহাবিপদ নিয়েও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। প্রকৃতিকে ক্রমাগত অবজ্ঞা করার প্রতিশোধ প্রকৃতি এখন নিচ্ছে। আগে ছোট ছোট আঞ্চলিক মহামারী পাঠিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছে। মানুষ সেই সতর্কতা অবজ্ঞা করায় এই বিশ্ব মহামহামারী। ক্যাপিটালিস্টেরা ভেবেছিলেন, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম দ্বারা সারা বিশ্বে তারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রকৃতি দেখালো তাদের সেই দর্প চূর্ণ করে তারাও গ্লোবাল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ইউরোপে এতকাল গ্রীন পার্টি নামে একটি দল আণবিক বোমা তৈরি ও তার পরীক্ষা দ্বারা আবহাওয়া এবং পরিবেশ দূষিতকরণের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে। এই দলের কথায় কেউ কান দেয়নি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দূর থেকে বিদ্যুতের আলো বলে মোর নাম রটে/মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে।’ তেমনই করোনা দানবের বিশ্ব গ্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্ব মানব সমাজ আবার বুঝতে পারছে, তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কি অন্যায় আচরণ করে চলেছে। করোনা বিশ্বের আর্থ সামাজিক চেহারা তো বদলাবেই, রাজনীতির চেহারাও বদলাচ্ছে। আগে বিশ্বের রাজনীতি ডানপন্থী ও বামপন্থী এই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। গালফ্্ যুদ্ধের সময় থেকেই এটা লুপ্ত হয়ে ডান ও বাম গলাগলি করছে। আমেরিকার কট্টর ডানপন্থী দল হলো রিপাবলিকান পার্টি। বিলাতের বাম এবং সমাজতন্ত্রী লেবার দলের সঙ্গে তাদের গলাগলি স্বপ্নেও ভাবা যায় না। গালফ্ যুদ্ধের শুরুতেই বুশের রিপাবলিকান পার্টি ও বিলাতে টনি ব্লেয়ারের লেবার পার্টির মধ্যে গলাগলি শুরু হয়। কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের কট্টর সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের মধ্যে ‘মিল মহব্বত’ হতে পারে? এই অনিশ্চয়তার যুগে তা হয়েছে। করোনা রাজনীতিতে এত কালের সংজ্ঞাটা বাতিল করে বাঘে ও মোষকে একঘাটে জল খাওয়াচ্ছে। আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি ‘বিধির বিধান ভাঙবে তুমি এমন শক্তিমান?’ না, প্রকৃতির বিধান ভাঙ্গে এমন শক্তি কারও নেই। তাই ইউরোপেই প্রথম প্রকৃতির বিধানের নবরূপ প্রকট হয়ে উঠছে। এক শ’ বছর পর অর্থাৎ, আইরিশ সিভিল ওয়ারের প্রায় শতবর্ষ পর আয়ারল্যান্ডের ডান ও বামের রাজনীতির প্রচলিত কাঠামো ভেঙ্গে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী কিয়ান্না ফেইল ও ফাইন গায়েল পার্টি দুটির মধ্যে কোয়ালিশন। এই কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে ২৯ বছর বয়সী প্রকৃতি রক্ষার গ্রীন পার্টি, যে কোয়ালিশন গঠন কয়েক দিন আগেও অসম্ভব মনে হয়েছিল। কোয়ালিশনের প্রথম দুটি দলই মধ্য ডানপন্থী। এখন তার সঙ্গে জুটেছে মধ্য বাম গ্রীন পার্টি। তাদের কাছে প্রায়োরিটি ক্লাইমেট চেঞ্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। ইকোনমিস্ট এই রাজনীতিকে আখ্যা দিয়েছে, ‘নিউ পলিটিক্স’Ñ নয়া রাজনীতি। আগের ডান ও বাম রাজনীতির স্থলে এই নয়া রাজনীতির উদ্ভব। জার্মানিতেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে মিলে গ্রীন পার্টি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। এই সরকারকে বলা হতো লাল সবুজ সরকার বা রেড গ্রীন গর্বমেন্ট। কিন্তু এখন পুরনো সমাজতন্ত্রের আবেদন জনগণের কাছে ফুরিয়ে গেছে। এখন সোশ্যালিজমের স্থলে পপুলার হচ্ছে এনভায়রনমেন্টালিজম। গ্রীন পার্টির আদর্শ। জার্মানিতেও যে কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও গ্রীন পার্টির। অস্ট্রিয়াতেও পিপলস পার্টি (মধ্য ডান) ও গ্রীন পার্টি কোয়ালিশনের কর্মসূচী হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণ কার্বন মুক্ত করা। অস্ট্রিয়াকে এই সরকার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি করোনামুক্ত রেখেছে। আয়ারল্যান্ডে গ্রীন পার্টির নেতা এমন রায়ান আগে একটি সাইকেলের দোকানের মালিক ছিলেন। তিনি কোয়ালিশন সরকারে ক্লাইমেট পরিবর্তন, যোগাযোগ ও ট্রান্সপোর্ট দফতরের মন্ত্রী। জার্মানিতে ভবিষ্যতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও গ্রীন পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা আগেই বলেছি। জার্মানিতে গ্রীন পার্টির পপুলারিটি দিন দিন বাড়ছে। তাদের দাবি ছিল ফুকুশিমা-দাইইচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করে দেয়া। এটায় একটা দুর্ঘটনা হওয়ার পর মিসেস মার্কেল জার্মানির সকল নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রিটেনে টোরি দলের মাইকেল গোভ সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে অধিক ‘প্রকৃতিপন্থী’ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের উচিত কৃষি জমি মালিকদের সাবসিডি দেয়ার বদলে জলবায়ু পরিবর্তনের কাজেই তাদের হাতে অর্থ বরাদ্দটা দেয়া। গ্রীন পলিটিক্সের ভবিষ্যত কি, তা ইকোনমিস্টও নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, করোনা গোটা মানব সমাজকেই ক্লাইমেট ও এনভায়রনমেন্টের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশকেও যে করবে তা সুনিশ্চিত। করোনার ফলে ঢাকায় যানজট অনেক কমেছে এবং পরিবেশ দূষণও অনেক কমেছে বলে জানা গেছে। মানুষ মরুক, পরিবেশ দূষণমুক্ত হোক তা কারও কাম্য নয়। সকলেরই কামনা, মানুষ বাঁচুক, প্রকৃতিও বাঁচুক। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। ইউরোপে গ্রীন পার্টির যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং আদর্শ হিসেবে সোশ্যালিজমের বদলে এনভায়রনমেন্টালিজমের যে গ্রহণযোগ্যতা তার কারণ, ওল্ড সোশ্যালিজম অর্থনীতির বর্তমান চাকা সবলে ঘোরাতে পারছেন না। পরিবেশবাদীরা সেখানে প্রকৃতি রক্ষা ও মানবতা রক্ষার নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছেন। বাংলাদেশেও ডান ও বাম রাজনীতির পার্থক্য শীঘ্রই ঘুচে যাবে। আবহাওয়া ও পরিবেশবাদী নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠবে, এটাই আশা করা যায়। আওয়ামী লীগও যদি তার রাজনৈতিক কর্মসূচীতে আবহাওয়া ও পরিবেশের দূষণ মুক্তিকে প্রাধান্য দেয়, বাজেট বরাদ্দ নতুনভাবে সাজায়, তাহলে আগামী দিনের রাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে। আবহাওয়া ও পরিবেশের দূষণমুক্তি হোক আওয়ামী লীগের করোনাবিরোধী যুদ্ধের নতুন সেøাগান। [লন্ডন, ৮ জুলাই, বুধবার, ২০২০]
×