ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১০৮ দিনেও পরিস্থিতির অবনতি

বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন করোনায়

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২৪ জুন ২০২০

বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন করোনায়

নিখিল মানখিন ॥ করোনায় জর্জরিত বিশ্বের প্রায় সব দেশে প্রথম শনাক্তের ৭০ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিম্নগামী হতে শুরু করে। বাংলাদেশে ১০৮ দিনেও পরিস্থিতির অবনতি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে। এখন পর্যন্ত দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উর্ধমুখী। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত পাকিস্তানসহ উপমহাদেশেই করোনায় আক্রান্তের নিম্নগামী হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা স্পেনে প্রথম আক্রান্তের ৬৩ দিন, ফ্রান্সে ৭৭ দিন, ইতালিতে ৬৫ দিন এবং যুক্তরাজ্যে ৭৯ দিন পর নিম্নগামী হয়ে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। প্রতি মাসে কয়েকদিনের ব্যতিক্রম উঠানামা ছাড়া ওইসব দেশে প্রতিদিন বা কয়েকদিন পর পরই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক শ’ করে হ্রাস পাওয়ার ধারাবাহিকতা রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশে^র করোনায় জর্জরিত একের পর এক দেশকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটি ইতোমধ্যে বিশে^ মোট রোগী শনাক্তে ১৭তম, দৈনিক রোগী শনাক্তে ৯ম এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যার বিবেচনায় ৩০তম স্থান দখল করেছে। চলতি বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। ১২ এপ্রিলের আগে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০০ এর নিচে। ১২ এপ্রিল দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ১০০ জন ছাড়িয়ে যায়। গত ১৭ এপ্রিল দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ১৯ এপ্রিল ৩০০ স্পর্শ করে। এভাবে প্রতিদিন বা কয়েকদিন পর পরই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক শ’ করে বাড়তে থাকে। ৩০ এপ্রিলে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৫৬৪ জনে। ৩ মে থেকে দৈনিক আক্রান্ত হতে থাকে ৬০০ জনের বেশি। এভাবে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১১ মে এক হাজারে, ২৮ মে দুই হাজারে এবং ৯ জুন তিন হাজারে প্রবেশ করে। এই পর্যায়ে এসে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা উর্ধমুখী হয়ে সমান্তরাল অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ ৯ জুন থেকে এখন পর্যন্ত দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কমে না গিয়ে মাঝখানে কয়েকদিন রেকর্ড সংখ্যক বেড়েছে। ২৩ জুনেও শনাক্ত হয়েছেন ৩৫৪৫ জন। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যার পরিসংখ্যানেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত ১৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটে। গত ৪ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা উর্ধমুখী হয়ে ৫ মে পর্যন্ত নিম্নমুখী হয়। কিন্তু ৭ মে এর পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঝখানের কয়েকদিনের ব্যতিক্রম ছাড়া দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও উর্ধমুখী হয়ে সমান্তরাল অবস্থায় রয়েছে। এভাবে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ মে ২০ জন এবং ৩১ মে ৩০ জন অতিক্রম করে। ৩১ মে থেকে এখন পর্যন্ত দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা মাঝখানে কয়েকদিন ৪০ অতিক্রম করলেও অধিকাংশ সময়েই ৩৫ থেকে ৩৯ জনের মধ্যে থাকছে। অর্থাৎ প্রতি মাসেই চার থেকে পাঁচদিন নি¤œগামী দেখা দিলেও বেশি সময় ধরে উর্ধগামী থাকার পরিসংখ্যানের কাছে তা দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারেনি। ২৩ জুনেও ৪৩ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মাসভিত্তিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান \ গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। মার্চে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫১ জন এবং ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটে। এভাবে মার্চে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫১ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫ জন। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট করোনা আক্রান্ত ৭৬৬৭ জন ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৭ জন । অর্থাৎ শুধু এপ্রিলের ৩০ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭৬১৬ জন এবং মৃত্যু ঘটেছে ১৬২ জনের। ৩১ মে পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট আক্রান্ত ৪৭ হাজার ১৫৩ জন এবং মৃত্যু হয় ৬৫০ জনের। অর্থাৎ শুধু মে মাসের ৩১ দিনে ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন এবং মৃত্যু ঘটে ৪৮৩ জনের। আর ২৩ জুন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ১৯৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৫৪৫ জনের। অর্থাৎ শুধু জুনের ২৩ দিনে মোট আক্রান্ত ৭২ হাজার ৪৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮৯৫ জনের। বিশে^র বিভিন্ন দেশের অবস্থা \ স্পেনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ৩১ জানুয়ারি। প্রথম আক্রান্তের ৩১ এপ্রিলে এসে স্পেনে দৈনিক করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। নিম্নগামী হওয়ার আগে ৩ এপ্রিল শনাক্ত হয় ৭১৩৪ জন করোনা রোগী এবং ৩০ এপ্রিলে এসে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪৪১ জনে এবং ৩১ মে ২৪ ঘণ্টায় ২০১ জনে। আর দৈনিক মৃতের সংখ্যার বিবেচনায় ২ এপ্রিল পর্যন্ত সিড়ি বেয়ে উঠতে থাকে দৈনিক মৃতের সংখ্যা। গত ২ এপ্রিল ৯৬১ জনের মৃতুর ঘটনার পর থেকে নিম্নগামী হয়ে ৩০ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ঘটে ২০১ জনের। স্পেনে প্রথম শনাক্তের ৬৩ দিনের পর আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী হয়ে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ফ্রান্সে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী হতে সময় লেগেছে ৭৭ দিন। ওই দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২৪ জানুয়ারি। প্রথম আক্রান্তের ৭৭ দিন অর্থাৎ ১০ এপিল ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৪২ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী হয়ে ৩০ এপ্রিল ২৪ শনাক্ত হয় ১১৩৯ জন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে ৩১ মে ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত হয় ২৫৭ জন। আর প্রথম আক্রান্তের পর বাড়তে বাড়তে গত ১৭ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় ৭৬১ জনের মৃত্যুর পর থেকে ফ্রান্সে করোনায় দৈনিক মৃতের সংখ্যা হ্রাসের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। এভাবে ৩০ এপ্রিলে ২৪ ঘণ্টায় ২৮৯ জন এবং ৩১ মে ২৪ ঘণ্টায় ৩১ জনের মৃত্যু ঘটে। আর ইতালিতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২১ ফেব্রæয়ারি। ওই ২৬ মার্চ ২৪ ঘণ্টায় ৬১৯১ জন আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নিম্নগামী হতে শুরু করে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এভাবে ইতালিতে গত ৩১ মার্চ ৪০৪৫ জন, ৩০ এপ্রিল ১৮৬৯ জন, ৩১ মে ৩৩৩ জন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়। নতুন আক্রান্তের হ্রাসের ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইতালিতে গত ২৭ মার্চ ২৪ ঘণ্টায় ৯১৯ জনের মৃত্যু হওয়ার পরদিন থেকে দৈনিক মৃতের সংখ্যা নিম্নগামী হতে শুরু করে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এভাবে গত ৩০ এপ্রিল ২৮৫ জন এবং ৩১ মে ২৪ ঘণ্টায় ৭৫ জনের মৃত্যু ঘটে। মৃতের সংখ্যার হ্রাসের এই ধারাবাহিকতা এখন এ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইতালিতে করোনায় দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী হতে সময় লেগেছে ৬৫ দিন। যুক্তরাজ্যে প্রথম আক্রান্তের ৭৯ দিন পর দৈনিক করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী হতে শুরু করে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ওই প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৩১ জানুয়ারি। আর ১৯ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় ৫৮৫০ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী হতে শুরু করে। এভাবে কমতে কমতে ৩১ মে ২৪ ঘণ্টায় ১৯৩৬ জন এবং ২২ জুন ২৪ ঘণ্টায় ৯৫৪ জন রোগী শনাক্ত হয়। আর ২১ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় ১১৭২ জনের মৃত্যু হওয়ার পরদিন থেকে দৈনিক মৃতের সংখ্যা নিম্নগামী হতে শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এভাবে গত ৩০ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় ৬৭৪ জন, ৩১ মে ১১৪ জন এবং ১৯ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৭৩ জনের মৃত্যু ঘটে। ভারত ও পাকিস্তানেও উর্ধমুখী \ ভারতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। প্রথম আক্রান্তের এখন পর্যন্ত ভারতের দৈনিক আকান্তের সংখ্যা উর্ধগামী। গত দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২ হাজার, ৪ মে ৩ হাজার, ১০ মে ৪ হাজার, ১৭ মে ৫ হাজার, ১৯ মে ৬ হাজার,২৯ মে ৮ হাজার, ৩ জুন ৯ হাজার, ৭ জুন ১০ হাজার, ১০ জুন ১২ হাজার, ১৭ জুন ১৩ হাজার, ১৯ জুন ১৪ হাজার এবং ২০ জুন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। ভারতে করোনায় দৈনিক মৃতের সংখ্যাও এখন পর্যন্ত উর্ধমুখী। ক্রমান্বয়ে বেড়ে গত ২ মে ভারতে দৈনিক মৃতের সংখ্যা ১০০ জনে পৌঁছে যায়। এরপর আর নিম্নগামী হয়নি। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বা কয়েকদিন পর পর বৃদ্ধি পেয়ে ২১ মে ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ জন, ২৯ মে ২০০ জন, ৬ জুন ৩০০ জন, ১৫ জুন ৪০০ জন এবং ২১ জুন ২৪ ঘণ্টায় ২২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং দৈনিক মৃতের সংখ্যার এই ধারাবাহিকতা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। আর পাকিস্তানে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২৭ ফেব্রæয়ারি। ভারতের মতো পাকিস্তানেও প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত দৈনিক রোগী শনাক্তের সংখ্যা উর্ধমুখী। পাকিস্তানে ২৪ ঘণ্টায় ৩ মে ১ হাজার, ২১ মে ২ হাজার, ৩১ মে ৩ হাজার, ৩ জুন ৪ হাজার, ১০ জুন ৫ হাজার, ১২ জুন ৬ হাজার এবং ২০ জুন ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে ৬ হাজার আক্রান্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত উর্ধমুখী রয়েছে। পাকিস্তানে করোনায় দৈনিক মৃতের সংখ্যাও এখন পর্যন্ত উর্ধমুখী। গত ১১ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত দৈনিক ২৫ থেকে ৫০ জন করে করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটে। গত ১১ জুনে দৈনিক মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ জনে। এভাবে বাড়তে বাড়তে দৈনিক মৃতের সংখ্যা গত ২০ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৫৩ জনের মৃত্যু ঘটার পর এখন পর্যন্ত উর্ধমুখী রয়েছে।
×