ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে নওগাঁয় কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৪ জানুয়ারি ২০২০

শীতে নওগাঁয় কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম

নওগাঁ বিভিন্ন উপজেলার পাড়ায়-মহল্লায় কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়েছে। আর এই বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার গৃহিণীরা। এই কুমরা বড়ি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চালান হচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে। শীতকালই হলো এই কুমড়া বড়ি তৈরির উপযুক্ত মৌসুম। নওগাঁ সদরের সুলতানপুর কালিতলাসহ সদরের বিভিন্ন গ্রামের পাড়া-মহল্লাসহ জেলার রাণীনগর, মান্দা, মহাদেবপুর, আত্রাইসহ সকল উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকেই বাড়ির উঠানে উঠানে চলে কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ। বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে পুরুষ এবং ছোট-বড় সকল বয়সের মানুষ সবাই মিলে তৈরি করেন এই কুমড়া বড়ি। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফাঁকা রোদ মাখানো বিভিন্ন স্থানে চাটাইয়ের ওপর সারি সারি করে বিছানো সাদা রঙের মাষকলাইয়ের তৈরি কুমড়া বড়ি শুকানো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার শুকনো বড়িগুলো বাঁশের চাটাই থেকে খুলছে আবার কেউ কেউ সেই বড়ির যতœ করছে। কারও যেন মুখ ঘুরানোর ফুরসত নেই। এ রকম অনেক দৃশ্য চোখে পড়বে। ভোর থেকে শুরু হয় এই কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ। এহলো মাষকলাইয়ের কুমড়া বড়ি তৈরির বর্ণনা। রাণীনগর উপজেলার সবচেয়ে বেশি কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে সদর ইউনিয়নের খট্টেশ্বর গ্রামে। শত বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করে আসছে এখানকার কারিগররা। খট্টেশ্বর গ্রামের ২০-২৫টি পরিবারের মানুষ পৈত্রিক এই পেশাটিকে ধরে রেখেছে। এই কটি কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগররাই আজও ধরে রেখেছে ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ি তৈরির শিল্পটি। সারা বছর টুকটাক বড়ি তৈরি হলেও শীত মৌসুমে এই কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। বর্তমানে ওই গ্রামের কারিগররা এই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীত মৌসুমে এই বড়ির চাহিদা বেশি থাকায় এখন ওই গ্রামে বড়ি তৈরি নিয়ে চলছে কারিগরদের প্রতিযোগিতা। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কুমড়া বড়ি তৈরি হয়ে থাকে তবে খুব সীমিত। শীতের ৬ মাসই মূলত এই বড়িটি তৈরি করা হয়ে থাকে। দিন দিন এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। কিন্তু বড়ি তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে। বড়ি তৈরির কারিগররা জানিয়েছেন, বড়ি তৈরির সব উপকরণই পুষ্টি গুণসম্পন্ন খাবার পণ্য। বড়িতে রয়েছে অধিক মানের পুষ্টি। বড়ি তৈরিতে প্রথমে মাষকলাই পানিতে ভিজিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে মেশিনে ভেঙ্গে গুঁড়া করে আবার তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রুটি তৈরির আটার মতো অবস্থায় পরিণত করা হয়। এর সঙ্গে চাল কুমড়া পিষিয়ে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। এরপর তা ২-৩ দিন রোদে শুকানোর পর বিক্রি করা হয়। বড়িকে শক্তিশালী করার জন্য এর সঙ্গে খুব কম পরিমাণে আতপ চালের আটা মিশানো হয়। প্রতি কেজি মাসকলাই থেকে প্রায় ৬ থেকে ৭ শ’ গ্রাম কুমড়া বড়ি তৈরি হয়। এই বড়ি মূলত মাষকলাই, চাল কুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোহরী দিয়ে তৈরি করা হয়। যে কোন রান্না করা তরকারির সঙ্গে এই কুমড়া বড়ি রান্না করা যায়। আর রান্নার পর তরকারিতে এই বড়ি যোগ করে অন্য রকমের এক স্বাদ হয়। বর্তমানে নওগাঁ শহরে ভাল মানের কুমড়া বড়ি খুচরা বাজারে ৩শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খট্টেশ্বর হাটখোলাপাড়া গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর সুবল চন্দ্র সরকার ও বলাই চন্দ্রসহ আরও অনেকেই জানান, কুমড়া বড়ি তৈরি আমাদের বাপ-দাদার পেশা। তাই আজো এই পেশা ধরে রেখেছি। এই বড়ি মূলত মাষকলাই, চালকুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোহরী দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি বড়ি ২২০-২৫০ টাকা (বড় আকারের) এবং ১২০-১৫০ টাকা (ছোট আকারের) করে পাইকারি বিক্রি করা হয়। নিজ এলাকার প্রয়োজন মিটিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, রংপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই কুমড়া বড়িগুলো সরবরাহ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিয়তই পাইকাররা এসে তাদের কাছ থেকে এই বড়ি কিনে নিয়ে যায়। তবে বড়ি তৈরির উপকরণের দাম বেশি হওয়াই এবার আমাদের লাভটা খুব কম। একই গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর মিঠন কুমার সরকার ও জয় কুমার আরও জানান, আমরা নিম্ন আয়ের কিছু মানুষ ঐতিহ্যপূর্ণ এই পৈত্রিক পেশাটিকে আজও ধরে রেখেছি। আমরা বিভিন্ন এনজিও-সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কোন মতে এই শিল্পটাকে ধরে রেখেছি। যার কারণে আমাদের ইচ্ছে থাকলেও এই শিল্পটাকে প্রসারিত করতে পারছি না। কারণ আমাদের পুঁজি কম। আমরা সরকারী সহযোগিতা বা কম সুদে যদি ঋণ পেতাম, তাহলে বড় ধরনের অর্থ খাটিয়ে এই শিল্পটাকে আরও অনেক বড় করতে পারতাম। আগের তুলনায় এখন বড়ি তৈরির উপকরণের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে। তবু শত কষ্টেও বাপ-দাদার এই পেশাটি আমরা ধরে রেখেছি। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×