ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নেপথ্যে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

নেপথ্যে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে বর্তমানে পেঁয়াজ একটি আলোচিত নাম। রান্নার কাজে ঘরে ঘরে, হোটেল রেস্তরাঁয় পেঁয়াজের নিত্য চাহিদা থাকে। কিন্তু পাশর্^বর্তী দেশ ভারত গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে আকস্মিক পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে পেঁয়াজের বাজার উর্ধমুখী হয়ে যায়। বর্তমানে এই উর্ধমুখিতা বিস্ময়কর পর্যায়ে পৌঁছুচ্ছে। এ যেন পেঁয়াজের বাজার মূল্যে পাগলা ঘোড়া। ফলে দেশজুড়ে পেঁয়াজ নামটি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরে পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৭ জনকে সোমবার থেকে ঢাকায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হওয়ায় অনেকের মাঝে অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে শূন্য মার্জিনে আমদানির সুযোগ করে দেয়া হলে বিপুল পরিমাণে দেশে পেঁয়াজ চলে আসবে এবং মূল্য হ্রাস পেতে বাধ্য বলে জানানো হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতির কারণে পেঁয়াজের বাজার তেজি অবস্থানে রয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বরের পর এ ঘটনা সৃষ্টি হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে দেশে পেঁয়াজের চাহিদার বড় অংশ মিটিয়ে আসছে ভারতীয় পেঁয়াজ। ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ কম বেশি পরিমাণে আসা শুরু হলে পেঁয়াজের মূল্য কিছুটা হ্রাস পায়। অর্থাৎ কেজি প্রতি পেঁয়াজ আড়াই শ’ টাকা থেকে ১৪০ টাকায় পর্যন্ত নেমে আসে। তবে আগেরকার স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। এ অবস্থায় গেল সপ্তাহ থেকে এই পেঁয়াজের বাজার আবার অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। প্রতিদিন মূল্য বেড়েই চলেছে। দেশের পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই থেকে। কেননা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রামে আসে। এর পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে আমদানির পেঁয়াজও প্রথমে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দরে। সে অনুসারে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারকে। খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেট ও চাক্তাই থেকে মূলত বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। সোমবার খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের পাইকারি দোকানগুলোতে পেঁয়াজের মূল্য আরেক দফা বেড়েছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ এক কেজি প্রতি ১৭০ থেকে ১৮০, মিসরের পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০, চীনা পেঁয়াজ ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ এর আগের দিন অর্থাৎ রবিবার মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়, মিসরের পেঁয়াজ ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়, আর চীনা পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে চীনা পেঁয়াজের চালান আসছে বলেও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। প্রতিদিন পেঁয়াজের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের পক্ষে জানানো হয়েছে, প্রতিদিন যে পরিমাণ পেঁয়াজের চাহিদা থাকে বাজারে জোগান আসছে তার অর্ধেকেরও কম। এই অবস্থায় পাইকারি দোকানগুলোতে খুচরা পর্যায়ের ক্রেতাদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার অবস্থা দৃশ্যমান। প্রতিদিন টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের পেঁয়াজ চট্টগ্রামে পৌঁছাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক। প্রতি ট্রাকে পেঁয়াজ থাকে ১৪ টন। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির মিসর, তুরস্ক ও চীনের পেঁয়াজ আসছে সামান্য পরিমাণ। ফলে বাজারে বড় ধরনের পেঁয়াজ সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বিশ^বাজারে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু দেশে সরবরাহে ঘাটতি থাকার কারণে পেঁয়াজের বাজার মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে আগে যেমন বেড়েছে এখন আবারও বেড়ে চলেছে। অপরদিকে, দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত এবং বড় শিল্প গ্রুপগুলো আমদানির পেঁয়াজ টিসিবি বিক্রি শুরু না করা পর্যন্ত স্বাভাবিক বাজার অস্বাভাবিক পর্যায়েই থাকবে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের পক্ষে জানানো হয়েছে, মূলত পেঁয়াজ নামের ভোগ্যপণ্যটি মজুদ করার কোন সুযোগ নেই। কারণ ৩ থেকে ৪ দিন পেরিয়ে গেলেই এতে পচন ধরে যায়। ফলে লাভের কথা দূরে থাক বিনিয়োগ উঠিয়ে আনাও সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় পেঁয়াজ এনে যত দ্রুত বিক্রি করে দেয়া যায় সে পথেই আড়তদারদের চিন্তা ভাবনা নিহিত থাকে। অথচ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে মজুদের যে অভিযোগ বাজারে চাউর হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মানতে নারাজ। এ অবস্থায় পেঁয়াজের মূল্য কেন বেড়ে চলেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের আমদানির পেঁয়াজ আমদানিকারকদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে কিনতে হচ্ছে বলেই পাইকারি বাজারে তা আঘাত হানছে। আর পাইকারি বাজারে এই অবস্থার জের টানতে হচ্ছে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। আর সর্বশেষ তা বর্তাচ্ছে ভোক্তা পর্যায়ে। খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের সঙ্গে আলাপ করে যে তথ্য মেলেছে সেটা হচ্ছে পেঁয়াজ আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক নেই। কিন্তু এই পণ্য আমদানিতে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি প্রক্রিয়ায় শূন্য হারে মার্জিন করে দেয়া এখন সময়ের দাবি। এতে করে অনেকে পেঁয়াজ আমদানিতে উৎসাহিত হবে এবং বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাবে। আর এতে করে বাজার মূল্য কমে যেতে বাধ্য। ব্যবসায়ীদের পক্ষে জানানো হয়েছে, বর্তমানে বিশ^বাজারের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ভারতে। এদেশটির বিভিন্ন প্রদেশে কেজি প্রতি ১২ রুপীতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে মহারাষ্ট্রে ১ কেজি পেঁয়াজের মূল্য বাংলাদেশী ১০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। সেদেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হতে যাওয়ার পথে ভারত সরকার নিজেদের স্বার্থে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে। এদিকে, মালয়েশিয়ায় কেজি প্রতি পেঁয়াজ বাংলাদেশী ৬০ থেকে ৭০ টাকা, চীনে ৩৫ টাকা, লেবাননে ৩০ টাকা, কুয়েত ও ওমানে ৫০ টাকা, বাহরাইনে ৫০ টাকা, উগান্ডায় ৬০ টাকা, ব্রাজিলে ৫০ টাকা, মিসরে ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কাতারে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা, দুবাইতে ৪৭ টাকা, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৭ টাকা, মালদ্বীপে ১২১ টাকা, সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকায় বর্তমানে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, চীন থেকে প্রতি টন পেঁয়াজের আমদানি মূল্য বর্তমানে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ ডলার, মিসরে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ ডলার এবং মিয়ানমারে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ ডলারে রয়েছে। বর্তমানে দেশীয় বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যে যেভাবে পারে মূল্য হাঁকছে। টিসিবি যে পেঁয়াজ বিক্রি করছে তা ভোক্তা পর্যায়ে কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না। এর পাশাপাশি আকাশপথে আমদানির পেঁয়াজও বাজার পরিস্থিতিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে আকাশপথে আমদানি যেমন অব্যাহত রয়েছে, তেমনি টিসিবির উদ্যোগে খোলাবাজারে বিক্রিও চলছে। পেঁয়াজের বাজার মূল্য বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা ও অধিদফতর শীর্ষস্থানীয় ৪৭ আমদানিকারককে সোমবার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। প্রথম দিনে ১৪ জনের মধ্যে ১০ জন আমদানিকারক বক্তব্য দিয়েছে অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. শহীদুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। অধিদফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, অবশিষ্টদের আজ এবং আগামীকালের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করা হবে। এসব আমদানিকারকদের প্রতিষ্ঠানে গত তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি ও বিক্রির যাবতীয় তথ্য নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
×