ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট কূটনীতি

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

ক্রিকেট কূটনীতি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সফর কোন রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। বরং তিনি গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীর ঐকান্তিক আমন্ত্রণে। যিনি সে দেশের একজন নামী-দামী ব্যাটসম্যান এবং কিংবদন্তিতুল্য অধিনায়ক। উদ্দেশ্য ছিল ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রথম গোলাপি বলে দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। উল্লেখ্য, ঘণ্টা বাজিয়ে টেস্টের উদ্বোধন করা ইডেনের বহু পুরনো রীতি। একই অনুষ্ঠানে সঙ্গত কারণেই উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও যথানিয়মে উপস্থিত থাকার কথা ছিল, যদিও শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার দরুন তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের নবেম্বরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম টেস্ট ম্যাচেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। এর বাইরেও সৌরভ বরাবরই বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রীরও একজন অনুরাগী এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে সহায়তা করতে প্রস্তুত। প্রসঙ্গত মনে পড়তে পারে বিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি প্রয়াত ডালমিয়ার কথাও, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন ও স্বীকৃতিতে যিনি ছিলেন অকৃপণ। তবে এসবই বাহ্য। ক্রিকেটীয় কূটনীতির বাইরেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হওয়া। সেটি আপাতত সম্ভব না হলেও এদিন সন্ধ্যায় তাজ বেঙ্গলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠককে নিতান্তই ঘরোয়া বলা হলেও তাতে যে পদ্মার ইলিশ থেকে শুরু করে তিস্তার পানি বণ্টনÑ প্রায় সবই স্থান পেয়েছে তাতে আর সন্দেহ কি! স্বীকার করতে হবে যে, দু’দেশের সম্পর্ক সেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান স্তরে অনন্য উচ্চতায় আরোহন করলেও ঝুলে আছে তিস্তা চুক্তি ও গঙ্গা ব্যারাজের বিষয়টি, যা বাংলাদেশের অন্যতম ন্যায্য দাবি। একদা প্রমত্তা ও খরস্রোতা তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে কমছে দিন দিন। বর্তমানে সরু নালার আকার ধারণ করেছে একদার কল্লোলিনী তিস্তা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ আগে ছিল ৪ হাজার কিউসেক। বর্তমানে সেটি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২শ’ কিউসেকে। নিকট অতীতের গড় প্রবাহের তুলনায় তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তার উজানে গজলডোবা পয়েন্টে বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ফলেই একদা প্রমত্তা নদীটির এহেন করুণ দশা। তিস্তা চুক্তি এখন বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত কোন অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনকানুন ভঙ্গ করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অবরুদ্ধ করতে পারে না। অথচ ভারত তাই করেছে প্রথমে গঙ্গা এবং পরে তিস্তা ও অন্যান্য নদ-নদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করে। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রেই ন্যায়ানুগ ও যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদ জানিয়েছে। দুঃখজনক হলো গঙ্গার পানি নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও গঙ্গা ব্যারাজসহ অন্যান্য নদ-নদীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নন। মমতা শুধু তিস্তা চুক্তিতে বাগড়া দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বেঁকে বসেছেন গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণেও। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ। এর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এটি নির্মিত হলে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় অংশেই পানির প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে। অথচ মমতা এখন গঙ্গা ব্যারাজেরও বিরোধিতা করছেন, যা মমতার বাংলাদেশ বিরোধিতার আরও একটি নমুনা। অথচ গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের আগেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে। অবশ্য তিস্তা চুক্তি ও গঙ্গা ব্যারাজের ব্যাপারে মমতাকে রাজি করানোর দায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের, বাংলাদেশের নয়। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেটিই দেখার বিষয়। ক্রিকেট কূটনীতি এখানে কোন ইতিবাচক ফল বয়ে আনে কিনা, সেটিও দেখা যেতে পারে।
×