ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবাসিক হলের কক্ষ নাম দিয়ে যায় চেনা...

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 আবাসিক হলের কক্ষ নাম দিয়ে যায় চেনা...

ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় বেগম রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনের ৩৫ নম্বর কক্ষটির নাম ‘একান্ত আপন’। ওই কক্ষে থাকেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সোনিয়া জেসমিন, দর্শনের সুমনা ইয়াছমিন, গ্রাফিক্স ডিজাইনের এলিজা হেলেন, কারুশিল্পের উর্মি এবং পদার্থ বিজ্ঞানের সাবরিন মোস্তফা। এক কক্ষে অনেকজনকে থাকতে হয় বলেই এমন নামকরণ বলছিলেন সোনিয়া জেসমিন। তিনি আরও বলেন, মনের মধ্যে লুকানো ভালবাসা তো সহজে কাউকে বোঝানো যায় না! কিন্তু আমরা সকল রুমমেট যে একান্ত আপন হয়ে পরিবারের সদস্যদের মতো থাকি তা কক্ষের নাম দেখলে সবাই বুঝে নিতে পারবে। একই হলের বর্ধিত ভবনের ৪২ নম্বর কক্ষের নাম ‘স্বপ্নচারী’। কক্ষের নাম সম্পর্কে জানতে চাইলে আফসানা মল্লিক তুলি বলেন, মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। বাস্তবের সঙ্গে মিল না থাকলেও অনেকেই পাহাড় সমান স্বপ্ন এঁকে বসে থাকেন। অনেকেই আবার নিজের মধ্যে লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সর্বদা ছুটে চলেন। স্বপ্ন দেখাই মানুষের ধর্ম। মানুষের সেই ধর্মের সঙ্গে মিল রেখেই কক্ষটির নাম রাখা হয়েছে স্বপ্নচারী। অমর একুশে হলের বিভিন্ন কক্ষের নামকরণে দেখা যায় বৈচিত্র্য। হলের অতিথি কক্ষের নাম ‘কিছুক্ষণ’, কেন্টিনের নাম ‘রসনা’, ক্যান্টিনে হাত ধোয়ার স্থানের নাম ‘প্রক্ষালন’, সেলুনের নাম ‘খেউরি’, লন্ড্রির নাম ‘শোভনীক’ আর টিভি রুমের নাম ‘নন্দন’। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ২২৯ নং কক্ষের নাম ‘ধইর‌্যা ড্রইং কইর‌্যা ছাইর‌্যা দিমু’। জানা যায়, ১৯৯২ সালে ড্রইং এ্যান্ড পেন্টিং বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হোসাইন মোহাম্মদ ফারুক কক্ষটির এমন নামকরণ করেন। একই হলের ২৩২ নং কক্ষের নাম ‘ঘুমেই শান্তি’। এ কক্ষের নামকরণ করেছেন প্রাক্তন ছাত্র আবদুল মোমেন মিল্টন। জানা যায়, এ কক্ষের বাসিন্দারা ঘুমানোর ব্যাপারে বেশ ওস্তাদ ছিলেন। সময় সুযোগ পেলেই দে ঘুম...। অধিক ঘুমানোর কারণে এ রকম নামকরণ করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মন্নুজান হলের ১১৭ নম্বর কক্ষটির নাম ‘স্বপ্ন বিলাস’। ওই কক্ষে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নচারী তিন মেধাবী ছাত্রী। এনিমেল হাজবেন্ড্রি এ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের মরিয়ম, ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যার রত্না এবং দর্শনের রুম্পা। কক্ষের নামকরণ সম্পর্কে খুরশিদ জাহান রুম্পা জানান, আমরা রুমের তিনজন মিলেই এই নামটি রেখেছি। স্বপ্নবিলাশী ডাকটা শুনলে আমরা মাঝে মাঝে কিছুটা বিরক্ত হই, তবে অনেক সময় নিজেকে স্বপ্ন বিলাসী ভাবতে খারাপ লাগে না। শাহ শখদুম হলের ১২৬ নম্বর কক্ষের নাম ‘শান্তির নীড়’। সেখানে থাকেন মিরাজ ও জাকির। কক্ষটি সম্পর্কে মিরাজ বলেন, গরম ও শীত যে কোন সময়ই আমাদের কক্ষটি একটি শান্তির আবাস। এটা যে শুধু আমার ধারণা তা নয়। হলের সবাই বলেন, আমাদের কক্ষের নামের সঙ্গে নাকি কক্ষটির বৈশিষ্ট্যের যথেষ্ট মিল রয়েছে। মাদার বখশ হলের ৩১২ নম্বর কক্ষের নাম রাখা হয়েছে ‘বালুচর’। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে হলটির নামকরণ করা হলেও কক্ষটির ভিন্ন নাম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নামকরণের কারণ কী তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রক্তিম বলেন, আমি কক্ষে ওঠার আগে থেকেই নামটি ছিল। কারা এ নাম রেখেছে তা আমার জানা নেই। নামটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। রোকেয়া হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষের নাম ‘সুপার নোভা’। ওই কক্ষে থাকেন দর্শন বিভাগের ফাল্গুনী, ব্যস্থাপনার বীথি ও অর্থনীতির রনি। মেয়েরা স্বভাবতই সুন্দরের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। নিজেদের সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে তারা সদা ব্যস্ত থাকেন। তাদের সেই মানসিকতা ফুটে উঠেছে কক্ষটির নামকরণের মধ্য দিয়ে। কক্ষের নামকরণ সম্পর্কে মনোয়ারা মনির ফাল্গুনী বলেন, নামটি আমাদের খুব পছন্দ। তবে এটা আমাদের দেয়া নাম নয়। বড় আপুরা কক্ষটির এই নাম রেখেছেন। নামটি আমাদের সবার পছন্দ হওয়ায় তা এখনও রয়ে গেছে। সৈয়দ আমির আলী হলের ৩২১ নম্বর কক্ষের নাম ‘প্যারাডাইস’। সেখানে থাকেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের মোস্তাকিম বিল্লাহ, ইতিহাসের আবদুল মতিন এবং দর্শনের মুকুল চন্দ্র দাস। এ নামকরণ সম্পর্কে মুকুল বলেন, প্যারাডাইস শব্দের অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ। যদিও আমরা এই হলে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই, তবুও নামটি অনেক সুন্দর লাগে। কাজে না হলেও কক্ষের নাম তো সর্বশ্রেষ্ঠ! এতেই সান্ত¡না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ সালাম-বরকত হলের ২৪৩ নম্বর কক্ষের নাম ‘লাইট ইয়ার্স’। ওই কক্ষে থাকেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের এরফান ও আতিকুর রহমান। বিজ্ঞানের প্রতি আলাদা একটি ঝোঁক থাকায় কক্ষটির নাম দেয়া হয়েছে ‘লাইট ইয়ার্স বা আলোকবর্ষ’। কক্ষটির নামকরণ সম্পর্কে এরফান বলেন, লক্ষ্য কোটি মাইল দূরের তারাদের জগত সব সময়ই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বিস্ময়কর দূরত্ব পরিমাপ করা হয় ‘আলোকবর্ষ’ হিসাব করে। সেখান থেকেই আমাদের কক্ষের এই রকম নাম দেয়া হয়েছে। ওই হলের তৃতীয় তলার বি-ব্লকের ৩২৭ নম্বর কক্ষটির নাম ‘ক্যারোলিনা’। ওই কক্ষের বাসিন্দা ফাহাদ। কক্ষের এমন নামকরণের কারণ কি? এমন প্রশ্নে ফাহাদ বলেন, আমি রাশিয়ান একটি উপন্যাস পড়ার সময় উপন্যাসের নায়িকার প্রেমে পড়ে যাই। উপন্যাসে ওই নায়িকার নাম ছিল ক্যারোলিনা। তাই নিজের ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে কক্ষের নাম রাখি কারোলিনা। মীর মোশাররফ হোসেন হলের এ-ব্লকের একটি কক্ষের নাম ‘ওয়াই ফাই’। কক্ষের বাসিন্দারা সারাদিন ফ্রি ওয়াইফাই ব্রাউজ করে বলেই কয়েকজন বন্ধু এই নাম রেখে দেয় বলে জানায় এ হলের এক বাসিন্দা। হলের বিভিন্ন কক্ষের নামকরণ সম্পর্কে এরফান বলেন, কক্ষের নামকরণের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সমকালীন চিন্তাভাবনা নানা প্রসঙ্গ। যেমন-বিসুপারনোভা, পাকুকুঞ্জ, মামাবাড়ি, গান্ডু ভিলা, সুনামী এক্সপ্রেস, সিলভার গ্রিন, ময়ূরাক্ষী, পাঠারহাটসহ আরও রকমারি কত নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের ৩২১ নম্বর কক্ষের নাম ‘ভেগাবন’। শব্দটির অর্থ উদ্দেশ্যহীন। ওই কক্ষে থাকেন আইন বিভাগের ফারুক ও তানিম। কক্ষটির নাম উদ্দেশ্যহীন হলেও তারা আসলে মোটেই উদ্দেশ্যহীন নয়। বরং তাদের জীবনধারা অনেকের চেয়ে পরিপাটি। কিন্তু তবুও কেন এই রকম নাম? উত্তরে ফারুক বলেন, আমরা আইনের শিক্ষার্থী। আইন নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাদের উদ্দেশ্যহীন হয়ে চলার কোন উপায় নেই। কিন্তু তবুও রুমের নামটি আমাদের খুবই পছন্দ। কক্ষের নাম ভেগাবন হওয়ায় হলের অনেকেই আমাদের ভবঘুরে বলে। মাঝে মাঝে এমনটা শুনতে ভালই লাগে। ওই হলের ১০৯ নম্বর কক্ষের নাম ‘বার কাউন্সিল’। ওই কক্ষে থাকছেন আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের তিন মেধাবী শিক্ষার্থী। আইন নিয়ে পড়াশোনা করায় কক্ষেরও নাম রেখেছেন বার কাউন্সিল। একই হলের ৩০৭ নম্বর কক্ষের নাম ‘প্রেসবক্স’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তব্যরত তিনজনই পড়াশোনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করায় কক্ষের এমন নাম রেখেছেন।
×