ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের জোরালো সমর্থন চাইবেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১০:৪০, ৩০ জুন ২০১৯

 রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের জোরালো সমর্থন চাইবেন প্রধানমন্ত্রী

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রাণে বাঁচাতে মানবতা দেখিয়ে তা এখন দেশের জন্য গলার ফাঁস হয়ে গেছে। এই গলার ফাঁস এমনভাবে আটকে আছে যা কোনভাবেই সরানো যাচ্ছে না। বিশ্ব দরবারে বহু আবেদন নিবেদন, বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট রিপোর্ট দেয়ার পরও কোন সুফল আসেনি। জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিধর বহু রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ের পক্ষে আওয়াজ তুললেও কার্যকর কোন সাফল্য আনতে পারেনি। মিয়ানমারের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একগুঁয়েমিতে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের পথ এখন সুদূর পরাহত। দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে এ ইঙ্গিত দিয়ে আসা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এই ইস্যুর সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে শক্তিশালী চীন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের সৃষ্টি। রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক। রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নানা ধরনের নিপীড়নের জের হিসেবে রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সময়জুড়ে সাগর, নদনদী ও স্থলপথে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তবে ’১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যজুড়ে সেনা অভিযানে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন যে হারে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকারী হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত থাকার কথা বলা হলেও বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। জাতিসংঘের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ’১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতের পর সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মূলত ওই সময়ে রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনা, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং উগ্রবাদীকে সম্মিলিত হামলায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণ হারানোর পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সরকার মানবিক কারণে ভীতসন্ত্রস্ত এসব রোহিঙ্গার প্রাণ বাঁচাতে দেশে আশ্রয় দেয়। এই আশ্রয় দেয়ার ঘটনায় রোহিঙ্গারা সে দেশে নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি, আশ্রয়স্থল ও সহায় সম্বল ফেলে বাংলাদেশে চলে আসে। কক্সবাজারের উখিয়া- টেকনাফের ৩০ আশ্রয় ক্যাম্পে সরকার এদের জন্য আশ্রয় শিবির নির্মাণ করে দিয়েছে। এদের বেঁচে থাকার জন্য শুরু থেকে যোগান দিয়েছে খাদ্যসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সরকারের পাশাপাশি এদেশের সাধারণ মানুষও এদের জন্য এগিয়ে যায়। এরপর এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, দাতা ও সাহায্য সংস্থা। এভাবেই এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নতুন জীবন পায়। অপরদিকে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারের পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রতিও সুষ্ঠু সমাধানের আহ্বান জানাতে থাকে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পানি বহু গভীরে গড়িয়ে গেছে। কিন্তু সামান্যতম সমাধানও আসেনি। একপর্যায়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সম্মতি প্রদান করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। কিন্তু প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ এগিয়ে এলে মিয়ানমার পক্ষ বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়। আর রোহিঙ্গারাও এতে বেঁকে বসে। তাদের পক্ষেও বেশকিছু শর্ত দেয়া হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রত্যাবাসনের আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। মূলত উভয় পক্ষে প্রদত্ত শর্তের বেড়াজালে আটকে যায় প্রত্যাবাসন ইস্যু। মিয়ানমার এখনও বলছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। আর রোহিঙ্গাদের দাবি হচ্ছে- শত শত বছর আগে থেকে বংশ পরম্পরায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে বসবাস করে আসছে। তবে রাখাইন রাজ্যেই এ জনগোষ্ঠীর আধিক্য রয়েছে। আগে এ রাজ্যকে আরাকান রাজ্য বলা হলেও মিয়ানমার সে নাম পাল্টে দিয়ে রাখাইন রাজ্য নাম দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন কারণ। যারমধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়েছে তেল ও গ্যাসের পাইপ লাইন, যা সিটওয়ে (সাবেক আকিয়াব বন্দর) থেকে সুদূর চীনের কুনমিন পর্যন্ত বিস্তৃত। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে রয়েছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ এদের আর্থিক সহায়তা যোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, চীনের জন্য বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় এবং মিয়ানমার নিজেদের পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাতের গোপন নীলনক্সা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার জের হিসেবে রাখাইন রাজ্যে গ্রামের পর গ্রাম পাড়ার পর পাড়া এখন বুলডোজারের মাটির চাপায় পড়েছে। সেখানে গড়ে ওঠেছে নতুন নতুন বৌদ্ধপল্লী। যা মিয়ানমার সরকারের জন্য হুমকিমুক্ত। এসব বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু আলোচনার পাশাপাশি বহুমুখী তদন্ত হয়েছে। সব আলোচনার নির্যাস ও তদন্তের ফল এসেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে। পক্ষান্তরে, এসব রিপোর্ট গেছে মিয়ানমারের বিপক্ষে। খোদ জাতিসংঘ প্রধান রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সফর করেছেন, সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির। শুধু জাতিসংঘ প্রধান নয়, বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান, ফার্স্ট লেডি, বিভিন্ন সাহায্য ও দাতা সংস্থার প্রধান, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রধান, বিভিন্ন দেশের তারকা শ্রেণীর সদস্যরাও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। সকলের কণ্ঠে একটি আওয়াজই বেরিয়ে এসেছে, আর তা হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। এছাড়া আরও বলা হয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব তিয়ে সসম্মানে ফিরিয়ে নিতে হবে মিয়ানমারকে। এ সবই এখন পর্যন্ত কথার কথা হয়ে আছে। কার্যকর কোন সফলতা বয়ে আসেনি। একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার এপর্যন্ত ফিরিয়ে নেয়নি। ফিরিয়ে নেয়ার কোন লক্ষণও তাদের মাঝে নেই। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করে প্রত্যাবাসনের কথা দিয়ে তারা কথা রাখছে না। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান তো দূরের কথা, তাদেরকে নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার পথ সুগম করতে মোটেই আগ্রহী নয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ সদস্যের অতি মানবিকতা প্রদর্শনের ফল আজ সরকারের জন্য বড় ধরনের গলার কাঁটা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্য দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য এসেছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর অবস্থা ডেকে আনছে। আর মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে কোন ধরনের আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ অবস্থায় এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মাদকের চোরাচালান, মানবপাচার থেকে শুরু করে হেন কোন অপরাধ ও বেআইনী কর্মকান্ড নেই যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে না। দিন দিন এ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা বিরাজ করছে কক্সবাজার অঞ্চলে মাদকের চোরাচালান ও মানবপাচারের ঘটনা নিয়ে। সরকার পক্ষে মাদকের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার পর মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা মাদক ইয়াবার চালান আসা ঠেকানো যাচ্ছে না। এ চালান নিয়ে আসার সঙ্গে রোহিঙ্গারা প্রধানত জড়িত। তবে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপে টেকনাফ থেকে সমুদ্র পথে মানবপাচার অনেকাংশে থমকে আছে। কিন্তু সুযোগ পেলেই মানবপাচারকারীরা যে কোন মুহূর্তে তৎপর যে হবে না তা আশা করা যায় না। অপরদিকে, প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে উখিয়া টেকনাফের পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি সেখানকার জনপদের বাসিন্দাদের মাঝেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। রোহিঙ্গারা আসার পর পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। বন জঙ্গল কেটে উজাড় করা হয়েছে। ফলে চলমান বর্ষা মৌসুমে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্প ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন পালাচ্ছে, তেমনি বিদেশ গমনও থেমে নেই। প্রতিনিয়ত এসব রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি বিমানবন্দরে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিনিয়ত যে হারে তাদের বংশ বৃদ্ধি ঘটছে তাও উদ্বেগজনক।
×