ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না ॥ হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ২০ মে ২০১৯

  মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না ॥ হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ছয় মাস নির্ধারণ করে জারি করা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ মূলত মানুষ আবেগের তাড়না থেকে করে, দেশের প্রতি ভালবাসার টানে করে। বয়স দিয়ে কখনও ভালবাসা বাঁধা যায় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাত/আট বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বাংলাদেশে তো শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বইও আছে। এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। রবিবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করে। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ওমর সাদাত, ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। গত ৪৫ বছর ধরে তারা (রিটকারীরা) সব সুবিধা পেয়ে আসছেন। হঠাৎ করে তারা জানলেন তারা আর মুক্তিযোদ্ধা নেই। তাই যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যদি অস্বীকার করি, তাহলে আমরা আর সামনে এগোতে পারব না। এছাড়াও রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৮ এর ২ এর ১১ ধারা অনুযায়ী বয়সসীমা বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ সংজ্ঞা নির্ধারণকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে আদালত। রায়ে বলা হয়, শহীদুল ইসলাম লালু একজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল দশ বছর। তার ছবি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু বয়স নির্ধারণ করে দেয়ায় তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ রয়ে গেছে। ফলে তাকে যে অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে এটা মেনে নেয়া যায় না। আদালত আরও বলেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাড়ে ১২ বছর বয়স নির্ধারণ সংবিধানের প্রস্তাবনা ও সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে স্থান পাওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এদিকে ৭ মার্চের ভাষণ পড়তে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ। তিনি বলেন, এক কঠিন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ একাত্তরের রণাঙ্গনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আর একাত্তর পরবর্তী সময়ে সেই ভাষণের মধ্যেই সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষ খুঁজে নিয়েছে তাদের মুক্তির পথ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ঘিরে হাইকোর্টে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো। রায় ঘোষণার পর ব্যারিস্টার ওমর সাদাত বলেন, ‘পরিপত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভাতা আটকে গিয়েছিল। কিন্তু আদালত আজ তাদের (রিটকারীর) সেই বকেয়া ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে রবিবারের এই রায়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে থাকলে এমন একদিন আসবে যেদিন মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে যাবেন রাজাকার আর রাজাকাররা হয়ে যাবেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই আদালত বলেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই, এটি একেবারেই অপরিবর্তনীয়। আদালত আরও বলেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংজ্ঞা দেয়ার কিছু নেই। এটি ঐতিহাসিক সাক্ষ্যর ভিত্তিতে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযোদ্ধা না তা নির্ধারণ হবে। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধাই। এখানে তর্কের কোন অবকাশ নেই।’ ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, পাবলিক সার্ভেন্টস (রিটায়ারমেন্ট) এ্যাক্ট-১৯৭৪ অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরির সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে দেয়ায় সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যা পাবলিক সার্ভেন্টস (রিটায়ারমেন্ট) এ্যাক্ট-১৯৭৪ এর ৪(এ) ধারা এবং সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত সপ্তাহে হাইকোর্টে রিটটি করা হয়। আদালত রিটের শুনানি নিয়ে রুল ও স্থগিতাদেশ জারি করে।
×