ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধরা স্বপ্নের অপমৃত্যু

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ১৬ মে ২০১৯

অধরা স্বপ্নের অপমৃত্যু

মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে থাকে। সুস্থ সুন্দর, সুচারু, সাবলীল ও সচ্ছল একটি জীবনযাপনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন মানুষ একা সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন করতে চায় না। বরং চায় নিজস্ব পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে তার এই আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক সুন্দর ও সুচারুভাবে। বাস্তবে সেই স্বপ্ন কি আদৌ বাস্তবায়ন হয়? অল্প কিছু মানুষের স্বপ্ন ও সাধ-আহ্লাদ নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন হয়। সমাজ-সংসারে তারা সুখী, সম্পন্ন ও পরিতৃপ্ত। তবে অধিকাংশ মানুষের স্বপ্নই বুঝি বাস্তবায়িত হয় না শেষ পর্যন্ত। স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত থেকে যায় স্বপ্নই অথবা অধরা। ১০ মে শুক্রবার তিউনিসিয়ার উপকূলে যে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে তাতে যাত্রী ছিলেন কম করেও ৭৫ জন, যাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ, মিসর, মরক্কো, সাদ ও আফ্রিকার নাগরিক। অন্তত ৫১ জন ছিলেন বাংলাদেশী। সবার স্বপ্নই ছিল এক ও অভিন্ন- নিতান্তই ভাগ্যান্বেষণে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া অথবা কানাডার কোন দেশে অবৈধ পথে পাড়ি দিয়ে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। নৌকাডুবির ঘটনায় সেই স্বপ্ন মুহূর্তে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। অনেকের লাশ মিলেছে, অনেকের মেলেনি- সলিল সমাধি ঘটেছে সেসব হতভাগার। কেউ দৈবক্রমে বেঁচে গেছেন বটে; তবে এই বেঁচে থাকা অবর্ণনীয়, অসহনীয়। মৃত্যুর অধিক এই বেঁচে থাকা। অনুরূপ কিছুদিন আগে আফ্রিকার দেশ ভানুয়াতুতে অবৈধভাবে গিয়ে কারাবন্দী জীবনযাপন করছেন অর্ধশতাধিক বাংলাদেশী। একেবারে নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীন বাংলাদেশীদের কেউ আর দেশে ফিরে আসতে চাইছেন না। দেশে ফিরে করবেন কি? খাবেন কি? বেঁচে থাকবেন কিভাবে? প্রায় সবাই তো গড়ে ৮-১০ লাখ টাকা দিয়েছেন দালালদের, যাদের মধ্যে রয়েছে দেশী-বিদেশী দালাল। ঢাকার ইউল্যাবের অধ্যাপক-গবেষকের মতে, অবৈধ মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সত্য বটে, বর্তমানে বিদেশে বৈধ পথে বিশেষ করে অদক্ষ ও আধা দক্ষদের জন্য কর্মসংস্থান কমে এসেছে অনেকাংশে। ইউরোপ-আমেরিকা দূরে থাক, মধ্যপ্রাচ্য-মালয়েশিয়ায় পর্যন্ত শ্রমিক প্রেরণ প্রায় বন্ধ । এর বিপরীতে বেড়েছে অবৈধ পথে মানবপাচার, যা থেকে এমনকি নারী ও শিশুও বাদ যাচ্ছে না। এক হিসাবে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ১৬ হাজার বাংলাদেশী অবৈধ পথে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে। কখনও দুর্গম অরণ্যাঞ্চল, কখনও ভয়ঙ্কর তপ্ত মরুভূমি আবার কখনওবা উত্তাল-উন্মত্ত সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে। ফলে অনিবার্য মৃত্যু ঘটছে অনেকের। যে বা যারা বেঁচে থাকেন তারাও প্রায় জীবন্মৃত। লক্ষাধিক বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। নারী ও শিশুদের স্থান হয়ে থাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে। অথচ দেশে থাকলে কিছু না কিছু করে বেঁচে থাকতে পারতেন এসব হতভাগা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে বর্তমানে প্রায় ৯৬ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের ১৬০টি দেশে কর্মরত আছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি, এক কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। এক হিসাবে হোম রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। পোশাক রফতানির পরেই এর অবস্থান। তবে সত্যি বলতে কি, প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ সামাজিক সুরক্ষার জন্য তেমন নীতিমালা ও আইন নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিরাপদ অভিবাসন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করলে ৫ বছরের জেল-জরিমানাসহ মানবপাচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রতারক, দালালচক্রসহ ঘৃণ্য মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির জন্য এরকম একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। এর পাশাপাশি জাতিসংঘ প্রস্তাবিত প্রবাসীদের জন্য জীবন বীমা তাদের দিতে পারে বাড়তি নিরাপত্তা। যা হোক, দেশী-বিদেশী ঘৃণ্য মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনটির প্রয়োগ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
×