ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিভৃত গ্রাম মশিদপুর

বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধন

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৩ মার্চ ২০১৯

  বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধন

বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছর অনন্য এক আয়োজন করে থাকে নওগাঁর মান্দা উপজেলার নিভৃত গ্রামের একদল উদ্যমী ও সমাজ সচেতন যুবক। অবহেলিত এ গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষায় বেরিয়ে আসা একদল যুবকের অনুপ্রেরণায় প্রতিবছর বইমেলার আয়োজন করা হয়। শিক্ষা বিস্তার, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ ছাড়াও মূলত শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে এ বই মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে দেশের শিক্ষাবিদরাও অতিথি হিসেবে হাজির হয়ে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান গ্রামের মানুষকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গেল ফেব্রুয়ারিতে হয়ে গেল অনন্য এ বইমেলা। ২০১০ সাল থেকে এভাবেই গ্রামের মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষায় প্রস্ফুটিত করে তুলতে প্রয়াস চালাচ্ছেন ওই তরুণরা। তাদের গড়ে তোলা সমিতির ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় এ ব্যতিক্রমী আয়োজন। এ সমিতির নাম ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’। এ সমিতির ব্যানারে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে ইমাজউদ্দিন মেমোরিয়াল বৃত্তি। বইমেলার দিনেই শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে তুলে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি। শুধু শিক্ষাবৃত্তিই নয়, দিনভর খাওয়া-দাওয়া আর পুরস্কার বিতরণ করা হয়। দেওয়া হয় চিকিৎসা সেবাও। রাজশাহীর তানোর ও নওগাঁর মান্দা আর নিয়ামতপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী তিন উপজেলার সন্ধিস্থল মান্দার চৌবাড়িয়া। সেখান থেকে আরো কিছুদুর ভেতরে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত একটি গ্রাম মশিদপুর। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর এ গ্রামে গত ৯ বছর ধরে বসছে বইমেলা। সঙ্গে নানা আয়োজন। ওই গ্রাম ও আশপাশের ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় সহ¯্রাধিক শিক্ষার্থী সমিতির আওতায় এসেছে। তারা শিক্ষাবৃত্তি ও অন্যান্য সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি হয়ে গেল দিনভর আয়োজন। সেখানে গিয়ে দেখা যায় শিশু, কিশোর-কিশোরী আবালবৃদ্ধবনিতা ও গ্রামের কৃষকরাও এ বইমেলায় এসেছেন। দিনভর পড়াশোনা-বই কেনাকাটায় বছরের একটি দিন যেন ব্যস্ত থাকেন এ গ্রামের মানুষ। শুধু এ গ্রামের মানুষের জন্য এ বই মেলার আয়োজন নয়, আশপাশের তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বইমেলাকে কেন্দ্র করে একদিনের উৎসবে মেতে ওঠেন। রাজশাহী শহর থেকেও বই ব্যবসায়ীরা ওই গ্রামে গিয়ে বসান বইয়ের স্টল। প্রতি বছরের একদিন বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই আয়োজন করা হয় এ গ্রামে। বই পড়া, বই কেনা ও শিক্ষার প্রতি প্রজন্মকে আগহী করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এ মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার পাশাপাশি ফ্রি মেডিক্যাল টেস্ট, ওষুধ বিতরণ ও গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয়ে থাকে। ২০১১ সাল থেকে একদিনের জন্য বই মেলার উৎসব হয়ে আসছে নিভৃত এ গ্রামে। নিভৃত পল্লীর কৃষি অধ্যুষিত এ গ্রামে এমন বই মেলার উদ্যোক্তাদের একজন ওই গ্রাম থেকেই উচ্চ শিক্ষায় বেরিয়ে আসা যুবক মো. আবদুর রাজ্জাক। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক তিনি। এ বইমেলার আয়োজন নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি শোনালেন নিভৃত গ্রামে বই মেলা আয়োজনের গল্প। আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মশিদপুর। সবক্ষেত্রে এ গ্রামের মানুষ অবহেলিত। এখানে অশিক্ষার হার অনেক বেশি। স্কুল থাকলেও নানা কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এ কারণে এ গ্রামে শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনিই মূলত গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি প্রতিষ্ঠান। এটির নাম ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’। এ সমিতির ব্যনারেই শিক্ষার প্রসারে নানা কার্যক্রম চলে বছরজুড়েই। আর প্রতিবছর ভাষার মাসে (ফেব্রুয়ারিতে) আয়োজন করা হয় বই মেলার। এ বছরের আয়োজন হয়ে গেল ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখে। ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর এ আয়োজন হয়ে আসছে। এখন উৎসবে রূপ নেয় এ বইমেলা। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে বইয়ের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, মেধাবীদের শিক্ষার প্রসারে এগিয়ে নিয়ে আসা, স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধ আর গ্রামের শিশুদের স্কুলমুখী করার লক্ষ্য নিয়ে মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি বইমেলার আয়োজন করে আসছে। প্রথমদিকে তেমন সাড়া না পেলেও এখন একদিনের বইমেলা উৎসবে এলাকায় দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে। শিশু কিশোর থেকে সব বয়সী মানুষ বইমেলায় হাজির হয়ে দিনভর বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেন। কৃষকরাও ওইদিন এ বইমেলায় হাজির হন। বই পড়েন। বই দেখেন, কিনেও নিয়ে যান অনেকে। এজন্য শিশুতোষ থেকে শুরু করে সব ধরনের বইয়ের স্টল দেয়া হয় ওই মেলায়। রাজশাহী নগরীর বইয়ের ব্যবসায়ীরা সেখানে স্টল বসান। তিনি বলেন, তাদের স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনের মাধ্যমে এখন সুবিধাভোগীদের সংখ্যা সহস্রাধিক। তারমতে মানুষের মধ্যে বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার কারণে ওই গ্রামে পর্যায়ক্রমে এখন শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকরাও তাদের শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে যত্নবান হচ্ছেন। আব্দুর রাজ্জাক জানান, প্রতিবছর বইমেলায় দেশের শিক্ষাবিদদের ওই গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা শিক্ষার উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দেন। গ্রামের মানুষ তাদের কথা মন দিয়ে শুনেন। ফলে শিশুদের বিদ্যালয়গামী করতে অভিভাবকরা মনোযোগী হন। -মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×