ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐক্যফ্রন্টের সরে পড়ার আশঙ্কায় জাপা প্রার্থীরা মাঠে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 ঐক্যফ্রন্টের সরে পড়ার আশঙ্কায় জাপা প্রার্থীরা মাঠে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের সিদ্ধান্তের বাইরে জাতীয় পার্টি থেকে যেসব প্রার্থী আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ নির্দেশ দেয়ার তিন ঘণ্টার মাথায় তা আবারও পরিবর্তন করেন তিনি। নিজের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, গণমাধ্যমে আমার বক্তব্য ভুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে। দলের কাউকে নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়াতে নির্দেশ দেন সাবেক এই সামরিক শাসক। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পরদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এরশাদ। প্রথমে তিনটি আসনে তাঁর নির্বাচন করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত রংপুর ছাড়া বাকি দুটি আসন ছেড়ে দেন (৮ পৃষ্ঠা ৩ কঃ দেখুন) রাজন ভট্টাচার্য ॥ আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের সিদ্ধান্তের বাইরে জাতীয় পার্টি থেকে যেসব প্রার্থী আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ নির্দেশ দেয়ার তিন ঘণ্টার মাথায় তা আবারও পরিবর্তন করেন তিনি। নিজের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, গণমাধ্যমে আমার বক্তব্য ভুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে। দলের কাউকে নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়াতে নির্দেশ দেন সাবেক এই সামরিক শাসক। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পরদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এরশাদ। প্রথমে তিনটি আসনে তাঁর নির্বাচন করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত রংপুর ছাড়া বাকি দুটি আসন ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু তিন ঘণ্টা পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা চলছে। বারবার মত পাল্টানো নেতা হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের আভাস পাওয়া গেলেও প্রকাশ্যে অনেকটা স্বাভাবিক ছিলেন এরশাদ। ২০১৪ সালে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তেও তিনি নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছিলেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সব প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মহাজোট গঠন নিয়ে এরশাদের নাটকীয়তার শেষ ছিল না। দলের নেতাদের মতে, নির্বাচন মানেই জাপায় নানামুখী নাটক। দলের নেতারা ভিন্ন ভিন্ন ধারায় অবস্থান নেয়ার কারণেই এরকম নাটকের শুরু হয় বলেও মত দিয়েছেন অনেকেই। প্রশ্ন হলো কেন মত পাল্টালেন এরশাদ। জাপার একাধিক শীর্ষ নেতা ও মহাজোটের শরিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের কৌশলগত কারণেই জাপা প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি অংশ নিলেও সারাদেশে তেমন একটা প্রচারে নেই এই জোটের প্রার্থীরা। নামমাত্র অংশগ্রহণ করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। যদিও ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা মাঠে না থাকার কারণ হিসেবে সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করে আসছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি জয়ের জন্য নির্বাচনে আসেনি তা বোঝার বাকি নেই কারো। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অনেক নেতার ধারণা ভোটের দিন কৌশলী অবস্থান নিয়ে নির্বাচন বর্জন করতে পারে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট ঐক্যফ্রন্ট। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে মাঠে থাকবে জাতীয় পার্টি। এতে জাপার বিরোধী দলে আসার সম্ভাবনা প্রবল। মূলত এরকম চিন্তা থেকেই জাপার প্রার্থীদের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও দলটির অপর প্রভাবশালী নেতা বরকতউল্লাহ বুলুর টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয়েছে শুক্রবার। এতে বিএনপিতে নির্বাচনের পক্ষে বিপক্ষে দুটি অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। একটি পক্ষ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য সর্বশেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। টেলিফোন সংলাপে মওদুদ বলেছেন, দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার স্বার্থে নির্বাচন করছেন তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি তাহলে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে নির্বাচন করছেন। আমরা নির্বাচন না করে ৩০০ প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে এনে রাস্তায় বসে পড়লেই এ খবরটি বিশে^ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারত বলেও যোগ করেন মওদুদ। তিনি বলেন, ফখরুল ইসলাম আমার ফোন ধরে না। তার পিএসও ফোন ধরে না। আমি সবকিছু তারেক রহমানকে জানিয়েছি। তাছাড়া গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসিন মন্টুর সঙ্গে এক ব্যক্তির টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়েছে কয়েকদিন আগে। এতে লন্ডনে তারেক রহমানের পরিকল্পনায় কামাল হোসেনকে নির্বাচনের আগে হত্যার জন্য নির্দেশ দেয়ার কথা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কামাল হোসেনকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার কথা বলা হয় টেলিফোনে। সব মিলিয়ে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে তা এখন আর হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর কিছু নেই। এবারের নির্বাচনে মহাজোট থেকে ২৯টি আসন পেয়েছে জাতীয় পার্টি। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ২৬টি আসনের কথা। এর বাইরে আলাদাভাবে আরও ১৪০টি আসনে উন্মুক্ত প্রার্থী রেখেছে দলটি। জাপার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- নৌকা নয়, ধানের শীষ ঠেকাতেই এই প্রার্থী দেয়া হয়েছে। জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন, সব মিলিয়ে ১৭৪টি আসনে তাদের প্রার্থী রয়েছে। তবে গেল ১০দিনে বিভিন্ন আসনে ১০ জনের বেশি প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে জাপার প্রার্থী দেয়া প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কৌশলগত কারণে উভয় দলের প্রার্থী রাখা হয়েছে। সময় মতো কৌশলের রহস্য প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। ১০ বছর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধার পর বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ-অনুযোগ করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বারিধারার নিজ বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি মহাজোট মনোনীত যেসব প্রার্থী আছে তারা ছাড়া অন্যদের সরে যেতে হবে। মহাজোটকে বিজয়ী করার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। যদিও রাতে তিনি প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। অসুস্থতা নিয়ে নাটকীয়ভাবে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর সেখান থেকে ফিরে তিনি বলেন, আমার বোন শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। আমি নির্বাচনে বোন শেখ হাসিনাকে সর্বোত সহযোগিতা করব। এরশাদ জানান, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মহাজোটের সিদ্ধান্তই মেনে চলবে। তিনি নিজেও ঢাকা-১৭ আসনে ভোট করা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত একটি আসনে লড়বেন সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ। তবে শুক্রবার তারসঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন ধরেননি। বনানী কার্যালয়েও দিনভর আসেননি এরশাদ। মহাজোট সরকার উন্নয়নের রোল মডেল একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে মহাজোটই জিতবে। কারণ বিএনপির অতীত ইতিহাস ভাল না। নৌকা নয়, ধানের শীষ ঠেকাতে জাপার আলাদা প্রার্থী দেয়া হয়েছিল। আমি সবাইকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রসঙ্গে এরশাদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কবি মানুষ, এ কারণে উল্টাপাল্টা বকছে। লেভেল প্লেয়িং কী জিনিস? যারা লেভেল প্লেয়িং নিয়ে কথা বলছে, তারা কি আদৌও এর অর্থ জানে?।’ সাংবাদিকদের তিনি জানান, জাতীয় নির্বাচনে ঢাকায় জাতীয় পার্টির দুই জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন, আবু হোসেন বাবলা ও কাজী ফিরোজ রশীদ। এদের জেতার সম্ভাবনা কম বলেও মন্তব্য করেন এরশাদ। রংপুরের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এরশাদ। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রংপুরে এতদিন যেতে পারিনি। তবে রংপুরে যাব। রংপুরের মানুষ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আশা করি, রংপুরবাসী এবার এই আসনটি মহাজোটকে উপহার দেবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরও বলেন, জনগণ এই সরকারের পক্ষে আছে। ভোটের যে পরিবেশ বজায় রয়েছে, তাতে আমরা খুশি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তবে আমার শরীরটা ভাল না। আমার বোন শেখ হাসিনার জন্যই আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমি ঢাকা-১৭ আসনটি ছেড়ে দিয়েছি। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চিত্রনায়ক ফারুককে সমর্থন দিয়েছি।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন এরশাদ। ২০১৪ সালে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান তিনি। এবারের নির্বাচনে আবারো ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী হন সাবেক এই সামরিক শাসক। কিন্তু মহাজোটে তাকে শুধুমাত্র রংপুরের আসনে সমর্থন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। তার পক্ষে প্রচার চালান দলের নেতাকর্মীরা। এই প্রেক্ষাপটে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা-১৭ আসন ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচনকে ঘিরে আসন বণ্টন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ৪০ আসন নিয়ে বিরোধী দলে থাকা জাপা এবারের নির্বাচনে ৭০টি আসন দাবি করেছিল। কিন্তু এবারে মহাজোটের পরিধি বাড়ায় জাপা আসন পায় ২৯টি। এতে ক্ষুব্ধ হন এরশাদ। রহস্যজনক কারণে তাকে ভর্তি করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সেখান থেকে ১০ ডিসেম্বর তাকে সিঙ্গাপুর চিকিৎসার নামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার অনুপস্থিতিতে দলের পক্ষ থেকে অন্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে জাপা প্রার্থীরা লাঙ্গল প্রতীকে প্রচার চালিয়েছেন। শুক্রবার দিনভর বারিধারার নিজ বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কেই ছিলেন এরশাদ। কোন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নেননি তিনি। অসুস্থতাজনিত কারণে রংপুর যাওয়ার কথা থাকলেও যাননি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ২৫১ আসন পায় জাপা। তখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর রাজনীতিতে সুসময় খুব একটা আসেনি তার। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তাকে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মামলায় জেলে রাখা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে অনেকটা স্বস্তিতে আছেন এরশাদ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল গঠন করে। গত পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ।
×