ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন শ’ বছরের পুরাকীর্তি অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্য এখন পর্যটন কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

তিন শ’ বছরের পুরাকীর্তি অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্য এখন পর্যটন কেন্দ্র

সাজেদ রহমান ॥ যশোরের ভৈরব নদপারের গ্রাম অভয়নগর। অনেক আগে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। এই অভয়নগরে তিন শ’ বছর আগে পাশাপাশি তৈরি করা হয় ১১ শিবমন্দির। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও জরাজীর্ণ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে সংস্কার হলো সেই ১১ শিবমন্দির। সংস্কার কাজ শেষ হওয়ায় শিবমন্দির তীর্থস্থান ও পর্যটন শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন এই শিবমন্দির দেখতে। একটু পেছনে তাকানো যাক। জানা যাবে শিবমন্দির সম্পর্কে। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রতাপশালী যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত ও বন্দী হন। ফলে রাজপরিবারের সদস্যরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে। তাদের একজন ঠাঁই নিয়েছিলেন যশোরের চাঁচড়ায়। এদের উত্তরপুরুষ রাজা নীলকণ্ঠ রায়। পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য ফেরান। ধন-দৌলত আর শক্তিসামর্থ্যে সবার সমীহ আদায় করে নেন তিনি। এই নীলকণ্ঠ রায়ের ঘর আলো করে জন্ম নিল এক কন্যাসন্তান। পিতা কন্যার নাম রাখলেন অভয়া। তখন বাংলায় চলছে ক্রান্তিকাল। এ অঞ্চলে জালের মতো বিস্তৃত শত শত নদ-নদী আর খাল-বিল। দক্ষিণে দুর্ভেদ্য সুন্দরবন। এই সুযোগ নিয়ে দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা এলাকার মানুষের ওপর চালাত নির্যাতন। ধনসম্পদ লুটের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। তাদের দমন করার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় উদ্যোগ নিলেন। ভৈরব নদের তীরে হিন্দুদের অতিপ্রাচীন তীর্থস্থান ভাটপাড়ার পাশে নদীর তীরে দুর্গ নির্মাণ করেন। তারপর রাজধানী চাঁচড়া থেকে এখানে সপরিবারে চলে আসেন। এখানেই বেড়ে উঠতে লাগলেন রাজকন্যা অভয়া। প্রাপ্তবয়স্ক হলে অভয়ার বিয়ে ঠিক করা হয় সে সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ‘নড়াইল জমিদার’ বংশের নীলাম্বর রায়ের সঙ্গে। অদৃষ্টের পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন রোগভোগের পরে মারা যান নীলাম্বর রায়। বিধবা হন রাজকন্যা অভয়া। তিনি ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। পিতার কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি তার বাকি জীবন মহাদেবের আরাধনা করেই কাটিয়ে দিতে চান। নীলকণ্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনে রাজবাড়ির কাছেই মেয়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করে দেন। একটি-দুটি নয়, ৬০ একর জায়গার ওপর এগারোটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন তিনি। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম রাখেন অভয়ানগর, যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। ভৈরব নদের তীরে এখনও দাঁড়িয়ে সেই স্থাপনা। এটি শুধু একটি সুন্দর মন্দিরই নয়, একইস্থানে এত শিবমন্দির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। এখন এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় মিলন পাল জানান, অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির প্রাচীন নিদর্শন। ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে রাজা নীলকণ্ঠ রায় এই ১১ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। সে হিসেবে মন্দিরগুলোর বয়স তিন শ’ বছরের বেশি। মন্দির নির্মাণে চুন-সুরকি ও ইটের ব্যবহার করা হয়। ইটের আকৃতি পাতলা ও বর্গাকার। চুন-সুরকির প্রলেপ ধরে রেখেছে ইটগুলোকে। পূর্ব ও পশ্চিম সারিতে চারটি করে মোট আটটি মন্দির। দক্ষিণ দিকে প্রবেশপথের দু’দিকে রয়েছে দুটি মন্দির। মূল মন্দিরটি পশ্চিম দিকে। সব মিলিয়ে এগারোটি মন্দির। প্রত্যেকটি মন্দির মাঝখানের উঠোনের দিকে মুখ করে অবস্থিত। মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রত্যেকটি মন্দিরে আগে একটি করে শিবলিঙ্গ ছিল, পরে চুরি হয়ে যায়। এখন শুধু মূল মন্দিরেই একটি শিবলিঙ্গ অবশিষ্ট। মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রধান প্রবেশপথ। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ ও উপ প্রবেশপথ, বাঁকানো কোণাকৃতির কার্নিস। আর রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্য। তার মধ্যে রয়েছে পদ্মসহ অনেক চিত্রের মোটিফ। মন্দিরের বিশেষত্ব হলো, এটি স্থানীয় রীতিতে নির্মিত। সে সময়ে যে বাংলায় উন্নতমানের স্থাপত্যশিল্প বর্তমান ছিল এটি তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। ছাদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চালা রীতিতে নির্মিত। সব মন্দির নির্মাণে অসাধারণ নির্মাণশৈলী এবং দক্ষতার ছাপ মেলে। মন্দিরটি একসময় প্রাচীরবেষ্টিত ছিল। এখনও তার চিহ্ন রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি পুকুর ছিল। এখন সেটি দখলদারদের কবলে। আর রাজবাড়ি? সেখানে এখন পানের বরজ! রাজা নীলকণ্ঠ রায় প্রতিটি মন্দিরের জন্য দু’শ’ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এই জমি থেকে মন্দিরের খরচ উঠে আসত। বড় মন্দিরে এখন নিত্যপুজো হয়।
×