গাফফার খান চৌধুরী ॥ ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর খবর নতুন নয়। এমনকি ফেসবুকে ভূরি ভূরি প্রেম হওয়ার নজিরও সত্য। ফেসবুকে প্রেম করে বিয়ে করার নজিরও কম না। তাই বলে ফেসবুকে হওয়া প্রেমের টানে চার বছরের অবুঝ সন্তানকে ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে মায়ের চলে যাওয়ার ঘটনা হরহামেশা শোনা যায় না। এমনই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে খোদ রাজধানীতেই। শিশু সন্তানটিকে নিয়ে দিশেহারা তার পিতা ও পরিবারের সদস্যরা। সারাক্ষণ শিশুটি মা মা বলে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। এমন কা-ে রীতিমতো হতভম্ব শিশুটির নানা-নানি ও দাদা-দাদির পরিবার। এমন ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত শেষে ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই।
পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, ফেসবুকে গুজবসহ নানা কারণে মামলা হওয়ার নজির আছে। কিন্তু ফেসবুকে প্রেমের সূত্র ধরে সন্তান রেখে মায়ের চলে যাওয়ার ঘটনা সাধারণত শোনা যায় না। বা মামলা হওয়ারও নজির নেই। এ ধরনের মামলা তদন্তের রেকর্ডও এই প্রথম।
তিনি আরও জানান, ঢাকার পল্লবী থানা এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী হাসান নামের এক ব্যক্তির ঢাকার সিএমএম আদালতে দায়ের করার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মিলেছে এমন তথ্য। মামলার অভিযোগে বাদীর দাবি, তার স্ত্রী ফেসবুকে আসক্ত ছিলেন। ফেসবুক থেকে এক ছাত্রের সঙ্গে প্রেম হয়। সেই প্রেমের সূত্র ধরেই তার স্ত্রী চার বছরের সন্তান রেখে বা কোন প্ররোচনায় পড়ে প্রেমিকের সঙ্গে চলে গেছেন।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা জনকণ্ঠকে জানান, মামলার বাদী হাসান চাকরিজীবী। তার সঙ্গে ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মৌ নামের এক মেয়ের ৪০ হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটছিল। তাদের সংসারে আলভিরা জান্নাত মাফতুহা নামের চার বছরের কন্যা সন্তানও আছে। মৌ গৃহিণী। পাশাপাশি পল্লবীতে এসপিকেএস মেডিক্যাল এ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল সহকারী কোর্সে পড়াশুনা করছিলেন। স্বামী প্রযুক্তি বিষয়ে চাকরি করায় বাসায় ইন্টারনেট ছিল। মৌ ২০১৭ সাল থেকেই মোবাইল ফোনে ফেসবুক চালাতেন।
ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইম এন্ড পুলিশ সাইন্স ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্সের ছাত্র রফিকুল ইসলাম রফিকের সঙ্গে। ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রেম। প্রেম থেকে তাদের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রফিক প্রায়ই টাঙ্গাইল থেকে পল্লবীতে যাতায়াত করতে থাকে। তারা পালিয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘোরাফেরা ও অবৈধ মেলামেশা করতে থাকে। মৌ প্রায়ই প্রেমিকের টানে রফিকের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে থাকেন। ছোট সন্তানকে বাড়িতে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোন বন্ধ করে হদিসহীন থাকার ঘটনায় হাসান ও তার পরিবারের সন্দেহ বাড়তে থাকে। চলতি বছরের কয়েক মাসে কয়েক দিন করে মৌ হদিসহীন হয়ে পড়ে। এতে করে হাসানের পরিবারে ও মৌর পরিবারের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত স্বামী হাসান স্ত্রীর মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ছবি দেখে স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। বারবার সাবধান করার পরও এবং দুই পরিবারের তরফ থেকে বুঝানোর পরও মৌ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। চলতি বছর মৌ শিশু সন্তানকে ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরকীয়া প্রেমিক রফিককে বিয়ে করেন। এরপর অনেক দেনদরবারের পরও মৌকে ফেরানো সম্ভব না হলে চলতি বছরের জুনে হাসান স্ত্রীকে তালাক দেন।
এ ব্যাপারে স্বামী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ফেসবুক খারাপ, এই ধারণা ভুল। ফেসবুক অবশ্যই ভাল জিনিস। তবে সব প্রযুক্তিগত জিনিসেরই একটি ভাল ও একটি মন্দ দিক থাকে। যে যেটি গ্রহণ করে। এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে ফেসবুক অবশ্যই সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত। স্ত্রী ফেসবুক ব্যবহার না করলে এমনটি নাও হতে পারত, আবার হওয়াটাও বিচিত্র ছিল না। সবই নিজের ওপর নির্ভর করছে।
শিশু সন্তানটি কেমন আছে জানতে চাইতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, সে অনেক ইতিহাস। এ নিয়ে পরিবারে বিষাদের ছায়া পড়ে গেছে। চার বছরের মেয়ে। তেমন কিছুই বুঝে না। বার বার মায়ের খোঁজ করে। ক্ষুধা লাগলে, কাপড় পরতে, বেড়াতে গেলে, এককথায় যে কোন কাজ করতে গেলেই মায়ের খোঁজ করে। মা মা বলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়। তা দেখে বাড়ির সবাই কাঁদে। তাকে তো আর বলে বোঝানো যায় না। এ নিয়ে আমার ও মেয়ের নানা-নানির পরিবারে চরম অশান্তি বিরাজ করছে। মেয়ের কষ্ট দেখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পরিবারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে গত একমাস আগে বিয়ে করেছি। তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ মেয়ে তার মাকে খোঁজে। এটিই স্বাভাবিক। শেষে আফসোস করে বলেন, হায়রে ফেসবুক প্রেম!